তুলসি গ্যাবার্ড বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের 'উদ্বেগের' কথা বলেছেন, এর প্রভাব কী হবে?

ভারতের গণমাধ্যম এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও 'ইসলামি খেলাফত' নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের প্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের করা মন্তব্য করেছেন সম্প্রতি। এনিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও জনপরিসরে।
ওই সাক্ষাৎকারে মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, বাংলাদেশে 'সংখ্যালঘু নির্যাতন' যুক্তরাষ্ট্রের 'উদ্বেগের একটি মূল জায়গাজুড়ে' রয়েছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্বেগের কথা জানান তিনি।
তিনি বলেন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ক্যাথলিক ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলমান দুর্ভাগ্যজনক নিপীড়ন, হত্যা ও অন্যান্য নির্যাতন যুক্তরাষ্ট্র সরকার, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের উদ্বেগের একটি প্রধান ক্ষেত্র।
তাঁর এ মন্তব্যের প্রভাব, এবং উগ্রবাদের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের আরও কঠোর হওয়া দরকার কিনা– এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, যা এখানে তুলে ধরা হলো—
'যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন, গ্যাবার্ডের মন্তব্যে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই'
জিল্লুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)

তুলসি গ্যাবার্ড কোনো নতুন বক্তব্য দেননি; তিনি কেবল বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থি উগ্রবাদ নিয়ে তার এবং ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ কীভাবে উঠে এসেছে, তা বিবেচনায় নেওয়াও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। একটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম তার সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল এবং প্রশ্নটি সুস্পষ্টভাবে দিকনির্দেশনামূলক ছিল।
জবাবে তিনি সংক্ষিপ্ত ও কূটনৈতিক ভাষায় উত্তর দেন। তিনি নিজে থেকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তুলতেন, এমন সম্ভাবনা খুব কম।
তবে একইসঙ্গে তার মন্তব্য ট্রাম্প সরকারের ইসলামবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডার বৃহত্তর প্যাটার্নের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
হিন্দু ধর্মানুসারী হিসেবে গ্যাবার্ড হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু বিশ্বব্যাপী বা ভারতের অভ্যন্তরে মুসলিমদের ওপর নিপীড়ন নিয়ে তিনি কোনো বক্তব্য দেননি।
এ থেকেই বোঝা যায়, তিনি মূলত সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর প্রশ্নের সূত্র ধরেই কথা বলেছেন। মার্কিন প্রশাসন বা নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন, তার বক্তব্য থেকে এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।
তবে অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে ইসলামপন্থি উগ্রবাদের পুনরুত্থান ঘটেছে। এই উদ্বেগ শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, পশ্চিমা পর্যবেক্ষক—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যেও রয়েছে।
এই পুনরুত্থানের দুটি দিক রয়েছে।
প্রথমত, গত ১৫-১৬ বছর ধরে ইসলামপন্থি উগ্র গোষ্ঠীগুলো বড় চাপে ছিল, ফলে তেমন তারা দৃশ্যমান ছিল না। এখন দীর্ঘ সময় পর তারা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, যা তাদের উপস্থিতিকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
দ্বিতীয়ত, সরকারের শাসনব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার ফলে উগ্রবাদী, এমনকি নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোও সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সরকার এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে এবং মোকাবিলা করতেও বিলম্ব করছে।
এই পুনরুত্থান নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক, বিশেষত উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। বর্তমানে সরকার পরিচালনা করছেন উদার গণতান্ত্রিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ড. ইউনূস। অনেক বিদেশি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে তার নেতৃত্বাধীন সরকার কীভাবে ইসলামপন্থি উগ্রবাদের উত্থান বরদাশত করছে।
এই সরকার অবশ্যই আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে, এবং ৫ আগস্টের পর আমরা সবাই এই সরকারকে সমর্থন দিয়েছি। তবে শাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থতার কারণে এ সরকার ধীরে ধীরে জনসমর্থন হারাচ্ছে। যদি এই বিষয়গুলোর সমাধান না করা হয়, তাহলে বাংলাদেশকে মারাত্মক ফল ভোগ করতে হতে পারে।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যদি দ্রুত নির্বাচন না হয় এবং ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে না যায়, তাহলে বাংলাদেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
(টেলিফোনে জিল্লুর রহমানের সাথে আলাপ করেন টিবিএসের জান্নাতুল নাঈম পিয়াল)
'সমাধানের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই সেরা উপায়'
হাবিবুর রহমান হাবিব, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা

বাংলাদেশে ৫ আগস্টের আগে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংগঠনগুলো ব্যাপক চাপের মধ্যে ছিল। মুক্তভাবে কার্যক্রম পরিচালনার কোনো উপায় বলতে গেলে ছিলই না। তবে এখন পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। বর্তমানে সবাই মুক্তভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে। এরই সুযোগ নিতে চাইছে হিজবুত তাহরীরের মতো কিছু নিষিদ্ধ গোষ্ঠীও।
এর আরেকটা কারণ হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর নিয়ন্ত্রণ এখনও পুরোপুরি নিতে পারেনি।
এটি উদ্বেগের একটা বড় জায়গা নিশ্চয়ই। কারণ যেসব গোষ্ঠীকে হুমকি হিসেবে গণ্য করা হয়– তারা কীভাবে প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাতে পারে? এইক্ষেত্রে সরকারের হয় নিয়ন্ত্রণের অভাব রয়েছে, অথবা কঠোর পদক্ষেপ নিতে অনীহা রয়েছে। ফলে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের বাইরেই রয়ে যাচ্ছে।
এই সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম উপায় হতে পারে, যত দ্রুত সম্ভব অবাধ ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত সরকার বৈধতা ও জনগণের সমর্থন পাবে। সেই সমর্থনের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা কঠোর ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে পারবে।
যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারের ওপর জনগণের আস্থা থাকে, ফলে কেবলমাত্র তারাই এধরনের গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে। তখন আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকাও নিশ্চিত হয়।
(টেলিফোনে হাবিবুর রহমান হাবিবের সঙ্গে কথা বলেছেন টিবিএসের অনন্য আফরোজ)
'যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের খোলামনে আলোচনা করা উচিৎ'
জন এফ ড্যানিলোভিচ, সাবেক মার্কিন কূটনীতিক

সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ এবং বাংলাদেশে উগ্রবাদের হুমকির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের উদ্বেগ উঠে এসেছে জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক গ্যাবার্ডের মন্তব্যে, যা এই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের আগে থেকেই রয়েছে।
আমি মনে করি, বন্ধু হিসেবে— বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ এসব বিষয় এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও খোলামনে সংলাপ করা।
ট্রাম্প প্রশাসনের টিম এখন সংগঠিত রূপ নিচ্ছে, আমি আশা করব, এসব বিষয়ে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের সমপদমর্যাদার কর্মকর্তারা সরাসরি কথা বলার সুযোগ পাবেন।
বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে যত ধরনের অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে ও অপপ্রচার চলছে, তাতে এধরনের সরাসরি সংলাপ আরও বেশি গুরুত্ববহ হয়ে উঠছে।
(টিবিএসের মাসুম বিল্লাহ'র যোগাযোগের প্রেক্ষিতে লিখিত এই প্রতিক্রিয়া পাঠান জন এফ ড্যানিলোভিচ)