যে দ্বীপ ছিল শুধুই ইঁদুরের দখলে, হারিয়ে গিয়েছিল প্রাণিকুল—সেখানেই যেভাবে ফিরে এলো প্রাণের কোলাহল

দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন স্বপ্নের দেশ। সাদা বালির সৈকত, স্বচ্ছ ফিরোজা নীল জল আর ঘন সবুজ অরণ্য—প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ভেসে থাকা এই দ্বীপগুলোর নাম বিকার অ্যাটল এবং জেমো আইলেট। কিন্তু কয়েক দশক ধরে এই স্বর্গভূমি দখল করে নিয়েছিল ইঁদুরের দল।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক সংস্থা 'আইল্যান্ড কনজারভেশন'-এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক পল জ্যাক যখন এই দ্বীপগুলোতে যান, তখন চারিদিক ইঁদুরে কিলবিল করছিল। তিনি বলেন, 'ওরা সবখানে দৌড়াদৌড়ি করছিল। রাতে টর্চ নিয়ে হাঁটলে ভয় লাগত—মনে হতো যেন পায়ের তলার মাটিটাই ইঁদুরের কারণে নড়ছে।'
এই ইঁদুরগুলো জাহাজের মাধ্যমে দ্বীপে এসে পরিবেশের ভারসাম্যটাই নষ্ট করে দিয়েছিল। তারা স্থানীয় গাছপালা খেয়ে সাবাড় করত, আর কাঁকড়ার বাচ্চা, পাখির ডিম এবং কচ্ছপের ছানাদের নির্মমভাবে শিকার করত। একসময় যে দ্বীপগুলো বিপন্ন সবুজ সামুদ্রিক কচ্ছপ এবং সামুদ্রিক পাখিদের কলকাকলিতে মুখর থাকত, সেখানে নেমে এসেছিল নীরবতা।
জ্যাক বলেন, 'স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা যখন প্রথমবার জেমো দ্বীপে এসেছিলেন, তখন এর নাম দিয়েছিলেন 'লস পাহারোস' অর্থাৎ 'পাখিদের দ্বীপ', কারণ সেখানে এত পাখি ছিল। কিন্তু আমরা যখন গেলাম, তখন হাতে গোনা কয়েকটি পাখি ছাড়া আর কিছুই ছিল না।'
কিন্তু এক বছর পর, সেই চিত্রটা পুরোপুরি বদলে গেছে। 'আইল্যান্ড কনজারভেশন' এবং মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মিলে এক সফল ইঁদুর নির্মূল অভিযান চালিয়েছে।

জ্যাক ব্যাখ্যা করেন, ড্রোনের সাহায্যে পুরো দ্বীপে এমনভাবে ইঁদুর মারার বিষটোপ ছিটানো হয়েছিল যাতে এক ইঞ্চিও জায়গা বাদ না যায়। এই বিষটোপ বিশেষভাবে ইঁদুরদের লক্ষ্য করে তৈরি, তাই অন্য প্রাণীদের ওপর এর প্রভাব খুবই কম। লক্ষ্য ছিল, প্রতিটি ইঁদুর যেন অন্তত একটি বিষটোপ খায়।
এই গ্রীষ্মে দলটি আবার সেই দ্বীপে ফিরে যায়—এবার ছিল ফলাফল দেখার পালা।
জ্যাক বলেন, 'দ্বীপে পা রাখার মুহূর্তটা ছিল অসাধারণ। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠেছিল। আমরা খুঁজছিলাম—ইঁদুর আছে কি নেই? মাটিতে পাখিরা বাসা বেঁধেছে কি না? যেকোনো একটা চিহ্ন, যা বলে দেবে আমরা জিতেছি না হেরেছি।'
এক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন—তারা জিতেছেন! ট্রেইল ক্যামেরা, ইঁদুর ধরার ফাঁদ এবং থার্মাল ডিটেকশন যন্ত্র দিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর তারা নিশ্চিত করলেন যে, দুটি দ্বীপই এখন সম্পূর্ণ ইঁদুরমুক্ত।

আর ফলাফল? অবিশ্বাস্য! সামুদ্রিক পাখিদের ঝাঁক ফিরে এসেছে। বিকার দ্বীপে প্রায় ২,০০০ স্যুুটি টার্ন পাখির একটি নতুন কলোনি তৈরি হয়েছে, যেখানে আগের বছর একটিও ছিল না। জ্যাক মাটিতে বাসা বাঁধা বাদামী নোডি এবং ক্রেস্টেড টার্ন দেখেছেন। এমনকি এমন কিছু প্রজাতির পাখি, টিকটিকি এবং কাঁকড়া দেখেছেন যা আগে কখনও রেকর্ড করা হয়নি। তিনি বলেন, 'ইঁদুরের অত্যাচারে যে প্রজাতিগুলো প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, তারা আবার ফিরে আসছে।'
তবে সবচেয়ে বড় সাফল্যের চিহ্ন ছিল মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠা হাজার হাজার পিসোনিয়া গাছের চারা। আগের বছর একটিও চারা ছিল না, আর এখন মাটি জুড়ে যেন সবুজ গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। জ্যাক বলেন, 'দ্বীপে ফিরেই এই দৃশ্যটা দেখে আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, এখানে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে গেছে।'
শুধু গাছপালা বা পাখিই নয়, পুরো দ্বীপটাই যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছিল। পাখির মল মাটিকে উর্বর করে তুলছে, আর কাঁকড়ারা তাদের লার্ভা সমুদ্রে ছাড়ছে যা অন্য সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্যের জোগান দিচ্ছে।

ঐতিহাসিকভাবে, জেমো দ্বীপটি পার্শ্ববর্তী লাইকিয়েপ অ্যাটলের সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ছিল। তারা মাছ ধরতে, কাঁকড়া শিকার করতে এবং নারকেল ও পান্ডান পাতা সংগ্রহ করতে এখানে আসত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সম্পদ নাটকীয়ভাবে কমে গিয়েছিল। কিন্তু এই প্রকল্পের পর, দ্বীপের বাসিন্দারা তাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার আশা দেখছেন।
এখন মূল লক্ষ্য হলো এই দ্বীপগুলোকে ইঁদুরমুক্ত রাখা। জ্যাক আত্মবিশ্বাসী যে এটি সম্ভব, কারণ দ্বীপগুলো অত্যন্ত দুর্গম।
আশার কথা হলো, এই সফল অভিযানটি এখন অন্যান্য দ্বীপগুলোর জন্যও একটি মডেল বা নকশা হিসেবে কাজ করবে।
একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, দ্বীপগুলোতে ৯০% বিলুপ্তির পেছনেই দায়ী এই বহিরাগত আগ্রাসী প্রজাতি। কিন্তু আশার কথা হলো, এই নির্মূল অভিযানগুলোর সাফল্যের হার ৮৮%।

জ্যাক বলেন, 'আপনি যদি কোনো আগ্রাসী প্রজাতিকে সরিয়ে দিতে পারেন, তবে এ যেন এমন এক উপহার, যা সময়ের সাথে সাথে বাড়তেই থাকে। ১০ বছর পর, ৩০ বছর পর, পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতো হয়। যেসব প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল, তারা আবার ফিরে আসে।'
'এই অসাধারণ রূপান্তর নিজের চোখে দেখার জন্যই আমি এই কাজটা করে যাই।'
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা