কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কর চাপে হুমকির মুখে পেপার কাপ শিল্প

- দেশে মাসে ২০ কোটি পেপার কাপের চাহিদা
- আন্তর্জাতিক বাজার ৩১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
দেশে পেপার কাপের চাহিদা বাড়লেও এর বাজার ধরতে পারছে না দেশীয় উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, পেপার কাপ উৎপাদনে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বেশি থাকায় বিকাশ ঘটছে না পেপার কাপ শিল্পের।
পেপার কাপ তৈরী করে এমন মালিকদের সংগঠন পেপার কাপ ম্যানুফ্যাকচারার এসোসিয়েশন বাংলাদেশের (পিসিএমএবি) তথ্য মতে, পেপার কাপ তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে বাংলাদেশে শুল্ক দিতে হয় ৬১ শতাংশ। যেখানে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা , ভারত পেপার কাপের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। অন্যদিকে নেপালে সাড়ে সাত শতাংশ, মিয়ানমারে ৫ শতাংশ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়।
শুল্ক বেশি থাকায় প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে উৎপাদন খরচে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। তাই পেপার কাপ তৈরীর কাঁচামাল আমদানীতে শুল্কমুক্ত সুবিধার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে পিসিএমএবি সম্প্রতি আবেদন করেছে।
তাদের মতে, পেপার কাপের বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজার ৩১৬ বিলিয়ন ডলারের। আর দেশে প্রতি মাসে পেপার কাপের চাহিদা ২০ কোটি পিস কাপ। গড়ে এক টাকা করে কাপের দাম হলে বছরে দেশে চাহিদা ২৪০ কোটি টাকার কাপ।
পিসিএমএবি'র সভাপতি ও কাগজের কাপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেপিসির মালিক কাজী সাজেদুর রহমান দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন বলেন, 'প্রস্তুতকৃত পেপার কাপ ও প্লেটের নূন্যতম আমদানি মূল্য প্রতি কেজি ১ দশমিক ৫ মার্কিন ডলার শুল্ক নির্ধারণ করা আছে। দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করতে এনবিআরের কাছে আমরা আবেদন করেছি ৩.৫০ ডলার শুল্ক নির্ধারণ করতে'।
কাজী সাজেদুর রহমান বলেন, 'ভারতে পেপার কাপের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক না থাকায় অনেক কম খরচে পণ্য উৎপাদন করতে পারছে তারা। আর সেই কাপ চলে আসছে বাংলাদেশে। আমাদের যদি কাঁচামাল আমদানির জন্য ডিউটি ফ্রি সুবিধা না দেওয়া হয় তাহলে এই শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে'।
মার্চের শুরুতে পূর্বাচলের কেপিসি কারখানায় গিয়ে দেখা যায় অর্ধেকের বেশি মেশিন বন্ধ রয়েছে। ১৫টি মেশিনের মধ্যে ছয়টি মেশিনে কাপ তৈরী হচ্ছে। কারখানায় দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ৮ লাখ পিস। কিন্তু এখন মাত্র ৩ থেকে ৪ লাখ পিস উৎপাদিত হয়। বর্তমানে শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা মিলে কেপিসিতে ৩০ জন লোক কাজ করেন।
করোনা পরিস্থিতিতে চা কফির জন্য কাগজের কাপের চাহিদা বেড়েছে। কফি শপ থেকে রেস্টুরেন্ট, এমনকি চায়ের দোকান সর্বত্রই বেড়েছে কাগজের কাপের ব্যবহারের চল। বর্তমানে দেশে মাসে ২০ কোটিরও বেশি পেপার কাপ বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে পাঁচ কোটি কাপ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহ করে। আমদানি হয় ১৫ কোটি কাপ। যার বেশিরভাগই ভারত থেকে আসে বলে জানায় পিসিএমএবি'র সভাপতি।
দেশে উৎপাদিত পেপার কাপের দাম
৮০ এমএল থেকে ৩৬০ এমএলের পেপার কাপ উৎপাদিত হয় দেশে। দাম ৮০ পয়সা থেকে আড়াই টাকা। ৮০ এমএল ৮০ পয়সা, ১০০ এমএল ৯০ পয়সা, ১২০ এমএল ৯৫ পয়সা । আর পেপারের তৈরী প্লেট তিন টাকা থেকে ৫ টাকা। এগুলো ৭ ইঞ্চি, ৮ ইঞ্চি, ৯ ইঞ্চি, ১০ ইঞ্চি আকারের প্লেট।
যেভাবে তৈরী হয় পেপার কাপ
একটি মেশিনে আমদানি করা কাগজের ওপর প্রথমে নকশা ও প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লোগো ছাপানো হয়। এর পর আরেকটি মেশিনে নির্দিষ্ট কাপের আকার অনুযায়ী কাটা হয়। এরপর কাটা কাগজগুলো আরেকটি যন্ত্রের মাধ্যমে তাপ দিয়ে কাপের আকার দেয়া হয়।
দাম বেড়েছে কাগজের
বর্তমানে পেপার কাপ তৈরীর কাগজ আমদানি বন্ধ রয়েছে জানিয়ে পিসিএমএবি এর সভাপতি বলেন, 'করোনার আগে এক টন কাগজের দাম ছিল ১১০০ থেকে ১২০০ ডলার। সেই কাগজের দাম বেড়ে হয়েছে ১৭০০ ডলার। এখন কাগজ আমদানিও বন্ধ হয়ে গেছে'।
পেপার কাপ একধরনের কাগজের তৈরি পাত্র,যা পরিবেশবান্ধব, এ পাত্র ব্যবহারের পর ফেলে দিলে তা মাটির সঙ্গে মিশে জৈব সার তৈরি হয়।
কাজী সাজেদুর রহমান বলেন, 'সম্ভাবনাময় খাত পেপার কাপ শিল্প। কাগজের কাপের বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজার ৩১৬ বিলিয়ন ডলারের। সরকার এ খাতে একটু নজর দিলে দেশের বাজারের চাহিদা পূরণ করে আন্তর্জাতিক বাজারও ধরতে পারবো আমরা। বর্তমানে যে চাহিদা তাতে ১০০টি প্রতিষ্ঠান পুরোদমে চালু থাকতে পারে অনায়াসে। সরকার পেপার কাপ ও পেপার প্লেট বাজারজাতকরণে সহায়তা দিলে নতুন এই সম্ভাবনাময় পণ্যের বাজারকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবো আমরা'।
টিএসএস এম্পায়ার একটি পেশাদার কাগজ পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। এটি বাংলাদেশের শীর্ষ ৫ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের একটি। ঢাকার বাউনিয়াতে টিএসএস এম্পায়ারের অফিস।
এর স্বত্বাধিকারী রাশেদ বলেন, তার প্রতিষ্ঠানে তিনটি মেশিন রয়েছে যা দিয়ে প্রতিদিন এক লাখ দশ হাজার কাপ তৈরী করার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু প্রতিযোগী বাজারে টিকতে না পেরে গত ২০ দিন ধরে তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
রাশেদ বলেন, 'আমাদের ব্যবসা বন্ধ রাখা ছাড়া উপায় নেই। এক দিকে কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে আর অন্যদিকে নিম্নমানের কাপ আমদানি হচ্ছে। এখন আমাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে পেপার কাপ উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল আমদানিতে শূণ্য শুল্ক রাখতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে ফিনিশড কাপ আমদানিতে শুল্ক বাড়াতে হবে'।
তিনি জানান, এ খাতে একশ'র বেশি উদ্যোক্তা তৈরী হয়েছে। তারা একটি মেশিন কিনে উৎপাদন শুরু করেছে। কিন্তু এখন টিকে থাকতে পারছেন না। এখন না পারছে মেশিন বিক্রি করতে , না পারছে পণ্য উৎপাদন করে বিক্রি করতে।