ট্রাম্পের শুল্ক স্থগিতে বিশ্ববাণিজ্যে কী প্রভাব পড়বে?

মার্কিন বাণিজ্যনীতিতে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন এসেছে। গত ২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'লিবারেশন ডে'-তে 'রেসিপ্রকাল ট্যারিফ' বা দেশগুলোর ওপর পারস্পরিক শুল্ক ঘোষণার পর বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতির বাজার একটা বড়সড় ধাক্কা খায়।
এর মাত্র এক সপ্তাহ পর, ৯ এপ্রিল কিছু শুল্ক সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার ঘোষণায় শেয়ারবাজারে স্বস্তি ফিরে আসে।
তবে শুল্কের এই ওঠানামার মধ্যে আসলে কী অবস্থা দাঁড়িয়েছে? কী প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক বাণিজ্যে?
স্থগিতাদেশে কী রয়েছে?
ট্রাম্পের ঘোষণায় ২ এপ্রিল থেকে নতুন করে যুক্ত হওয়া আমদানি শুল্কের মধ্যে কিছু শুল্ক আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে ৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়া ১০ শতাংশের সর্বনিম্ন নতুন শুল্ক সব দেশের জন্যই বহাল রয়েছে।
ফার্মাসিউটিক্যালস, মাইক্রোচিপসহ কিছু পণ্যে ছাড় থাকলেও বাকি সব পণ্যে এই শুল্ক কার্যকর। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাকি বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক বড় পরিবর্তন।
বিশেষ করে চীনের ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর কোনো সুযোগ নেই—বরং তা আরও বেড়ে দাঁড়াবে ১২৫ শতাংশে, যার সঙ্গে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ যুক্ত হবে ফেন্টানিল-সংক্রান্ত কারণে।

তবে ৫৯টি দেশের জন্য ১০ শতাংশের বেশি শুল্কের যেসব হার নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা জুলাই পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। যেমন- ভিয়েতনাম (৪৬%), শ্রীলঙ্কা (৪৪%) কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (২০%)।
এই সিদ্ধান্ত কিছুটা স্বস্তি এনেছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য, যেগুলোর অর্থনীতি মার্কিন রপ্তানির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। যেমন, ভিয়েতনামের অর্থনীতির ৩০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিনির্ভর। তাই ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হলে দেশটি মন্দার মুখে পড়তে পারত।
তবে একথাও ঠিক, এসব দেশ পূর্বে যেসব ক্ষেত্রে শুল্ক ছাড় পেত, এখন তাদেরকেও নতুন ১০ শতাংশ হার গুনতে হবে। এমনকি অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া, যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ছিল এবং শুল্ক ছিল শূন্য, সেসব চুক্তিও ট্রাম্প একতরফাভাবে বাতিল করেছেন। এমনকি কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গেও আগের চুক্তিগুলো বাতিল করা হয়েছে।

ট্রাম্পের ঘোষিত অন্য যেসব শুল্ক আগে থেকেই কার্যকর ছিল, সেগুলো এই স্থগিতাদেশের আওতায় পড়ছে না। এর মধ্যে রয়েছে:
- গাড়ি আমদানিতে ২৫ শতাংশ
- স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫ শতাংশ
- মেক্সিকো ও কানাডার অনেক পণ্যে ২৫ শতাংশ
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই সাময়িক স্থগিতাদেশ আসলে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক বাণিজ্যনীতির গতিপথে বড় কোনো পরিবর্তন আনছে না। ব্লুমবার্গ ইকোনমিকস-এর হিসাব অনুযায়ী, স্থগিতাদেশের আগপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের গড় আমদানি শুল্ক দাঁড়াত ২৭ শতাংশে, যা গত এক শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ। স্থগিতাদেশের পর তা দাঁড়াবে ২৪ শতাংশে—তবু সেটাও শত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
তাদের মতে, স্থগিতাদেশ তেমন পরিবর্তন আনেনি দুই কারণে-
এক, ১০ শতাংশ হারে শুল্ক এখন সব আমদানির ওপরই প্রযোজ্য। দুই, চীন থেকে আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক একসঙ্গে আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫ শতাংশে।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে ৪৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা তাদের মোট আমদানির ১৩ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এই নতুন শুল্ক ব্যবস্থা এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের নতুন পর্যায় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির ৪৩ শতাংশের জন্য দায়ী থাকবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ও প্রবৃদ্ধির পতন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অনিশ্চয়তাই বড় সমস্যা—এতে বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগের গতি থমকে যাবে এবং বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বড় ধাক্কা আসবে।