যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা আবেদন স্থগিত কেন? কারা ভোগান্তিতে পড়বেন?

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসগুলোকে নতুন শিক্ষার্থী ও এক্সচেঞ্জ [বিনিময়] ভিসা সাক্ষাৎকার বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
মঙ্গলবার ট্রাম্প প্রশাসনের একটি অভ্যন্তরীণ নির্দেশনার বরাতে এমনটা জানতে পেরেছে সংবাদ সংস্থাগুলো।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও স্বাক্ষরিত ওই আদেশে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যাচাই প্রক্রিয়া সম্প্রসারণের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্টেট ডিপার্টমেন্ট এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নির্দেশনায় বলা হয়, 'স্টেট ডিপার্টমেন্ট এখন শিক্ষার্থী এবং এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের (এফ, এম, জে) ভিসা আবেদনকারীদের যাচাই-বাছাইয়ের বিদ্যমান কার্যক্রম পর্যালোচনা করছে। সেই পর্যালোচনার ভিত্তিতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাই-বাছাই সম্প্রসারিত করার নির্দেশিকা জারি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এজন্যই, প্রয়োজনীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যাচাই-বাছাই সম্প্রসারণের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে, এখন থেকে কনস্যুলেট বিভাগ নতুন কোনো শিক্ষার্থী বা বিনিময় ভিসা সাক্ষাৎকারের সময়সীমা নির্ধারণ করবে না।'
সাধারণত 'এফ-১' ভিসা বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য, 'জে-১' বিনিময় এবং ফেলোশিপ কর্মসূচির জন্য, আর 'এম-১' প্রশিক্ষণ কর্মসূচির শিক্ষার্থীদের জন্য।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে জানান, এই স্থগিতাদেশ সাময়িক এবং ইতিমধ্যেই যারা সাক্ষাৎকারের ডাক পেয়েছেন, তারা এর আওতায় আসবেন না। তবে স্থগিতাদেশ কতদিন থাকবে, তা স্পষ্ট নয়।
পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এই আদেশ নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও তিনি বলেন, 'দেশে কারা প্রবেশ করছে, তা যাচাই করতে আমরা সব ধরনের উপায় ব্যবহার করব।'
প্রতি বছর কতজন বিদেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে আসেন?
আন্তর্জাতিক শিক্ষা সংস্থা এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক 'ওপেন ডোরস' প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ দশমিক ১৩ মিলিয়নে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এশিয়া থেকে এসেছে—শীর্ষে ভারত (৩ লাখ ৩১ হাজার ৬০০), তারপর চীন (২ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০) এবং দক্ষিণ কোরিয়া (৪৩ হাজার ১০০ জন)। ইউরোপ থেকে এসেছে প্রায় ৯০ হাজার ৬০০ শিক্ষার্থী।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যেখানে ২৭ হাজার ২৪৭ জন শিক্ষার্থী পড়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি (২১ হাজার ২৩) এবং তৃতীয় স্থানে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি (২০ হাজার ৩২১)।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের টানাপোড়েনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তি অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে। হার্ভার্ডে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার ৮০০ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী রয়েছে, যা মোট শিক্ষার্থীর ২৭ শতাংশ।
অন্য শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর অনুপাত প্রায় একই রকম। ইয়েল, নর্থওয়েস্টার্ন এবং নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীর প্রায় ২২ শতাংশই বিদেশি। রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে এই অনুপাত আরও বেশি, যেখানে মোট শিক্ষার্থীর ৩০ শতাংশ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দেশনায় শিক্ষার্থী ভিসার প্রক্রিয়া স্থগিত থাকায় কতজন শিক্ষার্থী এই শরৎকালীন (ফল) শিক্ষাবর্ষে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রোগ্রামে যোগ দিতে পারবেন, তা স্পষ্ট নয়।
বেশিরভাগ মার্কিন শিক্ষার্থী ভিসা কি ইতিমধ্যে ইস্যু হয়েছে?
প্রায় সব মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ই মার্চের শেষ বা এপ্রিলের শুরুতে ভর্তি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ফুলব্রাইট প্রোগ্রাম তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ধাপে ধাপে জানায়। শিক্ষার্থীরা সাধারণত তাদের ভর্তি সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর ভিসার জন্য আবেদন করে। আবেদন জমা দেওয়ার পর ভিসা পেতে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এফ-১ শিক্ষার্থী ভিসা প্রোগ্রামের শুরু তারিখের ৩৬৫ দিন (এক বছর) আগে পর্যন্ত ইস্যু করা যেতে পারে। তবে শিক্ষার্থীরা ওই প্রোগ্রামের শুরু তারিখের ৩০ দিন আগে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবে।
ভিসা নবায়ন প্রয়োজন এমন শিক্ষার্থীরা কী করবে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা যারা তাদের ভিসার মেয়াদ বাড়াতে বা নবায়ন করতে চায়, তাদের ক্ষেত্রে এই স্থগিতাদেশ প্রযোজ্য হবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
সাধারণত এফ-১ শিক্ষার্থী ভিসা পাঁচ বছরের জন্য প্রদান করা হয়। নবায়ন প্রক্রিয়াটি মূল আবেদন প্রক্রিয়ার মতোই হয়, যেখানে শিক্ষার্থীদের একটি অনলাইন ফর্ম পূরণ করতে হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্য কোনো মার্কিন দূতাবাসে সাক্ষাৎকারের সময় নির্ধারণ করতে হয়।
যেখানে স্নাতক প্রোগ্রাম সাধারণত চার বছর হয়, সেখানে পিএইচডি প্রোগ্রাম তিন থেকে আট বছর পর্যন্ত হতে পারে। ফলে অনেক পিএইচডি শিক্ষার্থী তাদের প্রোগ্রামের মধ্যবর্তী সময়ে ভিসা নবায়নের প্রয়োজন পড়ে।
এছাড়াও, যারা একটি ডিগ্রি সম্পন্ন করে আরেকটি ডিগ্রিতে (যেমন স্নাতক ডিগ্রি শেষে মাস্টার্স প্রোগ্রামে) যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়, তাদেরও ভিসা নবায়ন করতে হতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কী কারণ?
ট্রাম্প প্রশাসনের এই সর্বশেষ পদক্ষেপ মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপের অংশ। বিশেষ করে গত বছর গাজায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশকারী আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ওপর কঠোর নজরদারি বাড়ানো রয়েছে।
২০২৯ পর্যন্ত ভিসার মেয়াদ থাকলেও, এ বছরের মার্চের শুরুতে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর পরিকল্পনা বিভাগে পিএইচডিরত ৩৭ বছর বয়সী রঞ্জনী শ্রীনিবাসনের শিক্ষার্থী ভিসা যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক বাতিল করা হয়।
মার্চের শেষ দিকে আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলার সময় শ্রীনিবাসন জানান, তার দেয়া ভাষণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব বেশি সক্রিয় না থাকার কারণে তাকে লক্ষ্য করা হয়েছিল। তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে সমালোচনা করা বিষয়বস্তু শেয়ার এবং প্রকাশ করাও তার বিরুদ্ধে কাজ করেছে। এছাড়া, তিনি ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে কয়েকটি খোলা চিঠিতেও স্বাক্ষর করেছিলেন।
শ্রীনিবাসন জানান, তিনি কখনো কোনো সংগঠিত ক্যাম্পাস গ্রুপের সদস্য ছিলেন না। যদিও তিনি অতীতে ফিলিস্তিনের সমর্থনে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থিত ছিলেন না।
আল জাজিরাকে তিনি বলেন, 'মানবাধিকারের ধারণা সমর্থন করা বা গণহত্যা বন্ধ করার কথা বলা যদি হামাস সমর্থনের সমার্থক হয়, তাহলে আমার কাছাকাছি যারা আছেন—তাদের মধ্য থেকে কেউ কিছু না করেও শুধু আমার সঙ্গে সংযুক্ত থাকার কারণে গ্রেপ্তার হয়ে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।'