ট্রাম্প ও শি এমন এক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যা কেউ চায় না!

অন্যান্য দেশ মার্কিন পণ্যের আমদানিতে যে শুল্ক আরোপ করেছে, তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন 'পারস্পরিক শুল্ক' [রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ] আরোপ করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বদলানোর ঘোষণা দেন, তার কিছুক্ষণ আগে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তবে কথাটি কেউই ঠিক সেভাবে খেয়াল করেননি।
সেদিন (২ এপ্রিল) হোয়াইট হাউস রোজ গার্ডেনে ট্রাম্প বলেছিলেন, 'আমেরিকা এখন আর তাদের অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করতে পারে না। তিনি এও সতর্ক করেছিলেন যে 'যদি যুদ্ধের মতো কিছু ঘটে বা পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে আমরা সেটা সামাল দিতে পারব না।'
যদি ট্রাম্প কেবল অ্যান্টিবায়োটিকের কথা বলেই থেমে যেতেন, তাহলে হয়ত খুব কম মানুষই তার কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন। তিনি শুল্ক আরোপের বিষয়ে অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করেছেন। যেমন, বাণিজ্য ভারসাম্য করা, রাজস্ব বাড়ানো, চুক্তির জন্য একধরনের চাপ তৈরি করা।
এখন বলতে গেলে ওয়াশিংটনের প্রায় সবাই এ বিষয়ে একমত যে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন সক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা জরুরি, যাতে করে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে দেশটিকে অন্য কোনো দেশের ওপর নির্ভর করতে না হয়।
এখানেই থামলেন না ট্রাম্প। তিনি আরও খানিকটা এগোলেন। চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে সে দেশের পণ্যের ওপর শুল্কারোপের পাশাপাশি দীর্ঘদিনের মিত্রদেশগুলোর ওপরও শুল্কা আরোপ করলেন ট্রাম্প। আর এতেই বিশ্ববাজারে শুরু হলো বিশৃঙ্খলা। সেইসঙ্গে তার এই পদক্ষেপ এমন দেশগুলোর অর্থনীতির জন্যও ঝুঁকি তৈরি করল, যে দেশগুলোর সহযোগিতা কি না চীনের সঙ্গে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রেরই প্রয়োজন হতে পারে।
ট্রাম্প তিন মাসের জন্য আরোপিত পাল্টা শুল্ক স্থগিতের ঘোষণা দিলেও এটি এখন স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই বিশ্ব অর্থনীতিকে এমনভাবে বদলে দিচ্ছে যেন দেশ দুটি একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে—অথচ যা কেউই আসলে চায় না।
দুই দেশের এমন পদক্ষেপের মাশুল বিশ্বের অন্য দেশগুলোকেও গুনতে হবে। আর তাই এসব দেশ ভাবছে- এমন পরিস্থিতিতে তারা এই দুই দেশের কোনোটির ওপর ভরসা করবে, নাকি সময় হয়েছে নিজেদের অস্ত্রশক্তি বাড়িয়ে নেওয়ার।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও তার কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের আকাঙ্ক্ষা- যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনও আত্মনির্ভরশীল হবে। শি প্রায় এক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পণ্যের ওপর থেকে তার দেশের নির্ভরতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।
আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র যখনই যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সে সরকারই চীনকে এমন উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী হওয়া থেকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, যেটা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে।
কিছু দিক থেকে দেখতে গেলে ট্রাম্প সেই জিনিস পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করছেন যেটা চীনের আছে। আর শি আকাঙ্ক্ষা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের যা আছে তা পেতে। অর্থাৎ, ট্রাম্প চাইছেন চীনের মতো যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী উৎপাদন সক্ষমতা। অন্যদিকে শি চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনের উন্নত প্রযুক্তি ও বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা।
নিজেদের লক্ষ্য পূরণে ট্রাম্প ও শি দুজনেই বড় এবং সাহসী পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। তাতে বাজারে কি ধরনের প্রভাব পড়ল, সেদিকে খুব একটা নজর নেই তাদের।
২০২০ সালের শুরু থেকে শি কিছু বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও বন্ধ করে দেন, পরিকল্পিতভাবে সম্পত্তির দাম কমিয়ে দেন এবং করোনা মহামারির সময় সাংহাই শহরকে কয়েক মাস লকডাউনে রাখেন।
এসবের কারণে চীনের একটি বড় স্টক সূচক হাংসেং চায়না এন্টারপ্রাইজেস প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পতন হয়েছিল, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।
চীনের পদক্ষেপগুলো দেশটির কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় গভীর সক্ষমতার বিষয়টি স্পষ্ট করছে, বিশেষ করে আর্থিক খাতে। যে সময় দেশটির অর্থনীতির চাকা মন্থর হয়ে পড়েছিল, সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে বহু মেধাবী তরুণ কর্মীর বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি কাউকে কাউকে বোনাস পাওয়া অর্থও ফেরত দিতে হয়েছিল।
গত কয়েক বছরে শি বেশ কিছু বড় সফলতা অর্জন করেছেন। তার 'মেড ইন চায়না ২০২৫' পরিকল্পনার মাধ্যমে চীন কিছু অগ্রণী প্রযুক্তিখাতে শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছে।
২০২৪ সাল পর্যন্ত ব্লুমবার্গ ইকনোমিক্স ও ব্লুমবার্গ ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুযায়ী, সোলার প্যানেল, দ্রুতগতির ট্রেন ও লিথিয়াম ব্যাটারির মতো ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির মধ্যে ৫টিতে চীন শীর্ষে পৌঁছে গেছে। বাকি খাতগুলোতেও (যেমন ওষুধ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি।
এসব অর্জন বেইজিংয়ের নেতাদের মনে এই আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছে যে তারা দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে ভালো অবস্থানে রয়েছেন। পাশাপাশি তাদের যে উৎপাদন সক্ষমতা, সেটিও ভবিষ্যতে তারা ধরে রাখতে পারবেন।
ট্রাম্প যেমনটা মনে করেন যে দেশের নিরাপত্তার জন্য কারখানা প্রয়োজন, তেমনই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারাও সেটাই মনে করেন। তাদের এই ভাবনার কারণ- যদি কখনো এই অর্থনৈতিক লড়াই গোলাগুলির লড়াইয়ে রূপ নেয়, তাহলে যেন তারা নিজেরাই প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ সবকিছু তৈরি করতে পারে।
অন্যান্য দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর যে শুল্ক আরোপ করেছে, তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সম্প্রতি 'পারস্পরিক শুল্ক' বসানোর ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
গত বুধবার (২ এপ্রিল) হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প কোন দেশের ওপর কি পরিমাণ পারস্পরিক শুল্ক [রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ] আরোপ করছেন, তার একটি তালিকা তুলে ধরেন।
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কারোপের জবাবে গত বুধবার মার্কিন পণ্যের ওপর ৮৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে চীন। পরে যুক্তরাষ্ট্রও চীনের পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। জবাবে মার্কিন পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করার ঘোষণা দেয় চীন।
বেইজিং জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত আর কোনো শুল্কের জবাব দেবে না।
সংক্ষেপিত অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক