ওমানে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফলপ্রসূ’ আলোচনা; আগামী সপ্তাহে ফের বৈঠকে সম্মত

ওমানে অনুষ্ঠিত বৈঠককে 'ইতিবাচক' ও 'গঠনমূলক' বলে অভিহিত করেছে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র। তারা আগামী সপ্তাহেও তেহরানের ক্রমবর্ধমান পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত হয়েছে। যদিও এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে চুক্তি না হলে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ইরানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনকে বলেন, 'আমি মনে করি, আমরা আলোচনার একটি ভিত্তি নির্ধারণের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। যদি আগামী সপ্তাহে এই ভিত্তির চূড়ান্ত রূপরেখা নির্ধারণ করতে পারি, তাহলে এটি হবে একটি বড় অগ্রগতি এবং আমরা তখন সত্যিকারের আলোচনা শুরু করতে পারব।'
ট্রাম্প প্রশাসনের (২০১৭-২০২১ মেয়াদসহ) সঙ্গে এটিই ছিল ইরানের প্রথম আনুষ্ঠানিক আলোচনা। আরাগচি জানান, আলোচনাটি 'ফলপ্রসূ, শান্ত ও ইতিবাচক পরিবেশে' হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'উভয় পক্ষ আগামী শনিবার আবার আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে চায়। আমরা শুধু দেখানোর জন্য আলোচনা চাই না।'
হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভেন উইটকফ, ওমানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আনা এসক্রোজিমা এবং আরাগচিকে নিয়ে অনুষ্ঠিত এই আলোচনাকে তারা 'খুবই ইতিবাচক ও গঠনমূলক' হিসেবে দেখছে।
এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'এই বিষয়গুলো অত্যন্ত জটিল। তবে আজ বিশেষ দূত উইটকফের সরাসরি যোগাযোগ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি সমাধানে পৌঁছানোর পথে অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।'
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, 'উভয় পক্ষ আগামী শনিবার আবার বৈঠকে বসতে সম্মত হয়েছে।'
গতকাল শনিবার রাতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, 'আমি মনে করি, আলোচনা মন্দ হচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'কোনো কিছু চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত তার গুরুত্ব নেই, তাই আমি এ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি না। তবে আমার মনে হচ্ছে, ইরান ইস্যু মোটামুটি ভালোভাবেই এগোচ্ছে।'
এই মন্তব্য তিনি বিমানবাহিনীর প্রেসিডেনশিয়াল উড়োজাহাজ এয়ার ফোর্স ওয়ানে বসে দেন।
সোমবার এক চমকপ্রদ ঘোষণায় ট্রাম্প জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান ওমানে আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে। উপসাগরীয় দেশ ওমান আগেও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছে।
ওমান এর আগে ইরানে আটক একাধিক বিদেশি নাগরিক ও দ্বৈত নাগরিকত্বধারীর মুক্তির বিষয়েও সফলভাবে মধ্যস্থতা করেছে।
দুই পক্ষের অবস্থান এখনও অনেক দূরে
শনিবারের আলোচনাগুলো মুখোমুখি ছিল না, বরং ইরানের চাওয়ামতো ওমানের মধ্যস্থতায় পরোক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ট্রাম্প সরাসরি বৈঠকের পক্ষে থাকলেও, আলোচনা হয়েছে ইরানের প্রস্তাবিত পদ্ধতিতেই।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এসমাইল বাঘায়ি জানান, প্রতিটি প্রতিনিধিদলের জন্য আলাদা কক্ষ নির্ধারিত ছিল এবং তারা নিজেদের বার্তা ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে একে অপরের কাছে পাঠিয়েছে।
আরাগচি জানান, আলোচনা শেষ হওয়ার পর তার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে উইটকফের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে স্বল্প সময়ের জন্য মতবিনিময় হয়েছিল।
তিনি বলেন, 'দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পরোক্ষ আলোচনা চলার পর, বৈঠকস্থল ত্যাগ করার সময় ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের প্রধানরা ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে কয়েক মিনিটের জন্য কথা বলেন। এটি ছিল আমাদের রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ।'
একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, 'বৈঠকের বর্তমান মূল লক্ষ্য হচ্ছে আঞ্চলিক উত্তেজনা কমানো, বন্দি বিনিময় এবং কিছু সীমিত চুক্তি, যার মাধ্যমে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণের জন্য ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো কিছুটা শিথিল করা।'
তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বাঘায়ি। তবে কোন তথ্যটি সত্য নয় তা তিনি স্পষ্ট করেনি।
ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে এবং ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি অবলম্বন করেন।
এদিকে ইরান ও তার মিত্র গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের আঞ্চলিক পর্যায়ে পরিচালিত সামরিক আক্রমণের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার মধ্যে ইরানে বিমান হামলাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই হামলাগুলো ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের উপর হামাসের হামলার পর শুরু হয়।
এদিকে ভিয়েনায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত মিখাইল উলিয়ানভ আলোচনা শেষে উভয় পক্ষের প্রকাশিত বিবৃতিগুলোকে "উৎসাহজনক" বলে মন্তব্য করেছেন।
গতকাল শনিবার খুব সাবধানে আলোচনা শুরু করেছিল তেহরান। তারা সন্দিহান ছিল যে চুক্তি হবে কিনা এবং তারা ট্রাম্পের হুমকির বিষয়েও সন্দিহান ছিলেন। যদিও উভয় পক্ষই কিছু অগ্রগতির আশা প্রকাশ করেছে।
বাঘায়ি বলেন, "এটি মাত্র শুরু। তাই এই পর্যায়ে উভয় পক্ষই ওমানের মধ্যস্ততায় একে অপরের বিষয়ে জানাবেন এটাই স্বাভাবিক।"
আশা করা হচ্ছে, যদি এক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হয় তাহলে ২০২৩ সাল থেকে চলমান গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ, লেবানন যুদ্ধ, হুতিদের আক্রমণসহ বিভিন্ন বিষয়ে উত্তেজনা আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসবে।
উচ্চ ঝুঁকি
তবে, আলোচনা ব্যর্থ হলে এটি মধ্যপ্রাচ্যে একটি বৃহত্তর সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিবে। ইরান আশঙ্কা করছে, মার্কিন সেনাঘাঁটি থাকা প্রতিবেশী দেশগুলো যদি ইরানের ওপর হামলা চালায় তাহলে তাদের 'কঠোর পরিণতি' ভোগ করতে হবে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ইরানি টেলিভিশনকে বলেন, "যদি বিপরীত পক্ষ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) সমান অবস্থান নিয়ে আলোচনা শুরু করে, তবে পরবর্তী আলোচনার জন্য একটি প্রাথমিক বোঝাপড়ার সুযোগ থাকতে পারে।"
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাগচিকে আলোচনা পরিচালনার জন্য 'সম্পূর্ণ ক্ষমতা' দিয়েছে বলে রয়টার্সকে ইরানের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
ইরান তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা—যেমন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি—নিয়ে আলোচনা করার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছে।
পশ্চিমা দেশগুলো ইরানে পরমাণু জ্বালানি উৎস ইউরেনিয়ামের পরিমাণ একটি সাধারণ শক্তি কর্মসূচির জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি বলে দাবি করছে। তাদের অভিযোগ, এটি এমন এক স্তরে পৌঁছেছে যেখানে পারমাণবিক বোমার জন্য প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধতা অর্জন করেছে ইরান।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২০১৫ সালের চুক্তি থেকে সরে এসে ট্রাম্প ইরানের উপর 'সর্বোচ্চ চাপ' বজায় রেখেছেন। এর পর থেকেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি আরও সামনে এগিয়ে গেছে।