ট্রাম্পের নতুন শান্তি আলোচনার উদ্যোগ কেন চান না বা দরকারও নেই পুতিনের
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি ঘোষণা করেছিল যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠক হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা এমন বৈঠকের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন, যা শিগগিরই হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সবকিছু বদলে যায়। ক্রেমলিন জানায়, তারা এমন কোনো বৈঠকে সম্মতি দেয়নি। অন্যদিকে ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন, রাশিয়াই বৈঠকটি বাতিল করেছে। এরপর থেকে ট্রাম্প বলতে শুরু করেন, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আগাম কোনো সমঝোতা না হলে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করা "সময়ের অপচয়" হবে।
এই ঘটনাটিকে সহজেই "কি হতে পারত" ধরনের কূটনৈতিক নাটক বলে মনে করা যেতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এটি তুলে ধরে কিভাবে পুতিন ট্রাম্পের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করেন — যা ইউক্রেনের জন্য ক্ষতিকর।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি-কূটনীতি
পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি — দুজনেই জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যত নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পুতিন চান রাশিয়া আবারও এমন এক মহাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক, যার মর্যাদা যুক্তরাষ্ট্রের সমান। সেই লক্ষ্যে তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি-কূটনীতি চালান; কারণ তিনি জানেন, ট্রাম্প তার প্রতি একধরনের শ্রদ্ধা ও সম্মোহন পোষণ করেন।
পুতিন ট্রাম্পের অহংবোধকে কাজে লাগাতে জানেন। গত আগস্টে আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেন, পুতিন নাকি আমেরিকান ডাকযোগে ভোটব্যবস্থা নিয়ে তার উদ্বেগের সঙ্গে একমত হয়েছেন।
অক্টোবরে, পুতিন আবারও ট্রাম্পের প্রশংসা করেন — বিশেষ করে যখন ট্রাম্প ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের তালিকায় মনোনয়ন পাননি সেই সময়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের উদ্যোমী ভূমিকার প্রশংসায় ছিল তাঁর কণ্ঠে। ব্যক্তিগতভাবে ও প্রকাশ্যে পুতিন এভাবেই ট্রাম্পের প্রশংসা করে যান, তার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থানগুলোয় সমর্থন দেন, যাতে তাঁর প্রতি ট্রাম্পের সুনজর বজায় থাকে।
এরপর পুতিন এই বৈঠকগুলোকেই ব্যবহার করেন রাশিয়ার প্রচারণা ছড়ানোর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। যার মধ্য দিয়ে ক্রেমলিন ব্যাখ্যার চেষ্টা করে— কেন রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরু করেছিল; কিভাবে তারা ইতিহাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ইউক্রেনে নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠা করছে, কিংবা "সংঘাতের প্রকৃত কারণ" কীভাবে রাশিয়ার দৃষ্টিতে ভিন্ন।
এসব প্রচারের পর ট্রাম্প সাধারণত রাশিয়ার এই বয়ানগুলোরই পুনরাবৃত্তি করেন — গণমাধ্যমে বা অন্য বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠকে। তিনি এভাবে মন্তব্য করেছেন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও আগস্টে, এবং সর্বশেষ তা করেছেন গত ১৭ অক্টোবরে, যখন জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকে তিনি বারবার বলেছিলেন, ইউক্রেন যদি পুতিনের দাবি না মেনে চলে—তবে রাশিয়া দেশটিকে ধ্বংস করে দেবে।
পুতিনের তিনটি লক্ষ্য
পুতিনের এই কৌশলের তিনটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে।
প্রথমত, এটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের সম্পর্ককে টানাপোড়েনে ফেলে। স্মরণ করুন, গত ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউজে জেলেনস্কি, ট্রাম্প ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে. ডি. ভ্যান্সের মধ্যেকার বৈঠকটি — যা ঘটেছিল ট্রাম্পের প্রথম পুতিন-আলোচনার পরপরই — কতটা অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করেছিল। ওই সময়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে রীতিমতো অপমান হতে হয় জেলেনস্কিকে।
দ্বিতীয়ত, এতে ইউক্রেনের প্রত্যাশিত কিছু সামরিক সহায়তা বিলম্বিত বা বাতিল হয়ে যায়। যেমন, তথাকথিত হাঙ্গেরিয়ান সম্মেলনের ঘোষণাটি এসেছিল সেই দিন, যেদিন জেলেনস্কির ট্রাম্পের সঙ্গে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র কেনা নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল। কিন্তু তাদের বৈঠকের পর সেই চুক্তি আর হয়নি। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের এই হুমকি সরিয়ে দেওয়ার পরে, ক্রেমলিনের পক্ষে হাঙ্গেরিতে বৈঠক হবে এমন নাটক চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনও ফুরিয়ে যায়।
তৃতীয়ত, ভ্লাদিমির পুতিন চান যুক্তরাষ্ট্র–ইউরোপ জোটের ঐক্যে ভাঙন ধরাতে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র বেশিরভাগ সময়েই ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। কিন্তু ট্রাম্পের ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে সমালোচনা, এবং পুতিনের সঙ্গে তার উষ্ণ সম্পর্কের ধারণা, এই ঐক্যে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
যখন ট্রাম্প আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা আশঙ্কা করেছিল — ট্রাম্প হয়তো রাশিয়ার পক্ষে সুবিধাজনক কোনো "শান্তি চুক্তি" ইউক্রেনের ওপর চাপিয়ে দেবেন। কয়েক দিন পর জেলেনস্কি ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করলে ইউরোপীয় নেতারাও সঙ্গে ছিলেন, আরেকটি বিপর্যয় এড়ানোর আশায়।
শেষপর্যন্ত বৈঠকটি ইতিবাচকভাবে শেষ হয়, এবং যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান নেয় — এমনকি সাময়িকভাবে হলেও, সম্ভাব্য শান্তি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে আমেরিকান নিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
এই ঘটনাটি আরও ইঙ্গিত দেয়, জেলেনস্কিও এখন ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করছেন। ইউক্রেন জানে, যুক্তরাষ্ট্র তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র; তাই ট্রাম্পের লেনদেনমুখী চরিত্র বুঝে সে কাঁচামাল সরবরাহ ও অস্ত্র কেনার চুক্তি করেছে, ন্যাটোর সহায়তায় যুক্ত থেকেছে।
জেলেনস্কি সম্পর্ক পুনর্গঠনের জন্যও ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকে কাজে লাগিয়েছেন। এপ্রিল মাসে তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় — হোয়াইট হাউজের বিতর্কিত বৈঠকের পর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টায়।
আগস্টে জেলেনস্কি ইচ্ছাকৃতভাবে ট্রাম্পের কাছে ইতিবাচক ছাপ ফেলতে চেয়েছিলেন, যাতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য বৈঠকের পর ট্রাম্পের প্রো-রাশিয়ান প্রতিক্রিয়া সামলানো যায়। তাই তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে এবার স্যুট পরে যান — যা ছিল হোয়াইট হাউসের বৈঠকে তার পোশাক নিয়ে ট্রাম্পের করা সমালোচনার সূক্ষ্ম জবাব।
ট্রাম্প যেহেতু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধানে নিজের মধ্যস্থতার ইচ্ছা জোরালোভাবে প্রকাশ করেছেন, তাই পুতিন ও জেলেনস্কি — দুজনেই জানেন কিভাবে এই ইচ্ছাকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগাতে হয়।
ট্রাম্প কাহিনির আরেক অধ্যায়
ট্রাম্প-পুতিনের হাঙ্গেরিতে বৈঠক স্থগিত বা বাতিল হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে রাশিয়ার তেল কোম্পানি ও তাদের ক্রেতাদের ওপর। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আর "সময় নষ্ট" করবেন না, যতক্ষণ না পুতিন "শান্তির ব্যাপারে সিরিয়াস" হন।
তবে সেই অপেক্ষা দীর্ঘ হবে বলেই মনে হচ্ছে। রাশিয়া তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পুতিন এখনো পর্যন্ত ইউক্রেন বিষয়ে নিজের মূল দাবিগুলো থেকে একচুলও সরেননি।
ভবিষ্যতে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে আরেকটি বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু শান্তির আশায় অনেকেই যতটা আশাবাদী, বাস্তবে এসব কূটনৈতিক পর্ব বরং বেশি প্রকাশ করে পুতিনের কৌশলগত দক্ষতা — যখন দরকার, তখন কীভাবে ট্রাম্পকে ব্যবহার করতে হয় — সে সম্পর্কে বোঝাপড়ার দিকটি। এটি তার মধ্যে প্রকৃত শান্তিচেতনার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে।
লেখক: ওলেক্সা দ্রাচেভিচ কানাডার ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। এই লেখাটি এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত তার মূল নিবন্ধ থেকে টিবিএসের পাঠকদের জন্য অনূদিত।
