প্রথম সন্তানেরা কেন নেতৃত্বে এগিয়ে থাকে
'জন্মগত নেতা'- ধারণাটি এতটাই অতিরঞ্জিত ও গতানুগতিক শোনায় যে মনে হয় এটি কোনো নিম্নমানের ব্যবসায়িক বইয়ের প্রচ্ছদে বা কোনো চটকদার টিভি সংবাদ বিশ্লেষকের মুখে মানায়।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো 'জন্মগত নেতা' বিষয়টি সত্যিই আছে।
গবেষকরা এমন একটি মূল উপাদান চিহ্নিত করেছেন, যা জিন, বাবা-মা বা বন্ধুবান্ধব কেউই নয়— সেটি হলো জন্মক্রম।
নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম সন্তানদের মধ্যে সিইও বা রাজনীতিক হওয়ার সম্ভাবনা ৩০ শতাংশ বেশি।
গবেষণাটি করেছেন টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ স্যান্ড্রা ই. ব্ল্যাক এবং সুইডেনের ইনস্টিটিউট ফর ইভ্যালুয়েশন অব লেবার মার্কেট অ্যান্ড এডুকেশন পলিসি'র বিয়র্ন অকের্ত ও এরিক গ্রোনকভিস্ট।
শুধুমাত্র ছেলেদের ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম সন্তানরা স্কুলে বেশি সময় থাকে, বেশি উপার্জন করে, তাদের আইকিউ বেশি, এমনকি তারা টেলিভিশনের চেয়ে পড়াশোনায় বেশি সময় দেয়।
জন্মক্রম ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে এই ধারণার সূত্রপাত অন্তত ১৯২০-এর দশকে।
মনোবিজ্ঞানী আলফ্রেড অ্যাডলার সেসময় বলেছিলেন, প্রথম সন্তানদের ছোটবেলাতেই 'ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ' গড়ে ওঠে, কারণ তারা ছোট ভাইবোনদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং পরিবারের সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে যাওয়ার আশঙ্কায় সতর্ক থাকে।
তার মতে, সবচেয়ে ছোট সন্তানরা অতিরিক্ত আদর-যত্নে নির্ভরশীল হয়ে ওঠে ('বেবি অব দ্য ফ্যামিলি' প্রভাব), আর মধ্যম সন্তানরা বাবা-মায়ের মনোযোগের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে স্বভাবতই প্রতিদ্বন্দ্বী ও অবস্থানসচেতন হয়।
জন্মক্রম থেকে ব্যক্তিত্ব নির্ধারণের বিষয়টি আমার মতো অনেকের কাছেই ফ্রয়েডীয় ধাঁচের কল্পবিজ্ঞান মনে হতে পারে। কিন্তু অ্যাডলারের ধারণাগুলো বহু গবেষণায় টিকে আছে।
২০১৩ সালের 'স্ট্র্যাটেজিক প্যারেন্টিং, বার্থ অর্ডার অ্যান্ড স্কুল পারফরম্যান্স' গবেষণায় ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি. জোসেফ হোটজ ও ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জুয়ান প্যান্টানো দেখিয়েছেন, জন্মক্রম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাগত পারফরম্যান্স কমে যায়।
তাদের মতে, বাবা-মা প্রথম সন্তানের জন্য কঠোর নিয়ম স্থাপন করেন, যা পরিবারে নিয়ম ও শৃঙ্খলার সংস্কৃতি তৈরি করে। ফলে বড় সন্তানরা একদিকে বেশি মনোযোগ পায়, অন্যদিকে পরিবারে নিয়মরক্ষক হিসেবে ভূমিকা রেখে বুদ্ধিমত্তা ও নেতৃত্বগুণ অর্জন করে।
জরিপে দেখা গেছে, বাবা-মায়েরা বড় সন্তানদের বেশি সফল মনে করেন এবং ছোট সন্তানদের তুলনায় তাদের কম শাসন করেন।
নতুন গবেষণাটি সুইডিশ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এক্ষেত্রেও গবেষকরা একই ধরনের ফলাফল পেয়েছে।
দেখা গেছে, প্রথম সন্তানরা শুধু বুদ্ধিমান বা সুস্থ নয়, তারা আবেগীয় স্থিতিশীলতা, অধ্যবসায়, সামাজিকতা, দায়িত্ববোধ ও উদ্যোগী মনোভাবের দিক থেকেও এগিয়ে।
গবেষকরা জিনগত কারণগুলোকে বাদ দিয়ে বলেন, আসল পার্থক্য তৈরি হয় পরিবারের প্রাথমিক পর্যায়ের গতিশীলতায়।
প্রথমত, পরিবারের সন্তানসংখ্যা বাড়লে বাবা-মা প্রত্যেক সন্তানের প্রতি কম সময় দিতে পারেন, যার ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে প্রভাব পড়ে।
দ্বিতীয়ত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হতে পারে 'কৌশলগত পিতামাতৃত্ব' নয়, বরং 'কৌশলগত ভ্রাতৃত্ব'। ভাইবোনরা বাবা-মায়ের ভালোবাসা পেতে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে নির্দিষ্ট ভূমিকা তৈরি করে— বড়রা নিজেদের সক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেখায়, আর ছোটরা মনোযোগ পেতে সৃজনশীল উপায় খোঁজে।
বিশেষ করে যেসব ছোট ছেলে বড় ভাইয়ের সঙ্গে বড় হয়, তাদের মধ্যে এই প্রভাব স্পষ্ট।
গবেষণায় দেখা গেছে, বড় ভাই থাকলে ছোট ভাইয়ের সৃজনশীল পেশায় (যেমন স্থপতি, লেখক, অভিনেতা, গায়ক বা আলোকচিত্রী) প্রবেশের সম্ভাবনা বেশি। অর্থাৎ, ভাইদের মধ্যে পারিবারিক ভূমিকার বিশেষায়ন ভবিষ্যতে পেশাগত বিশেষায়নের দিকনির্দেশ করে।
গবেষকরা বলছেন, শৈশবের পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ একজন মানুষের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ছোট শিশুরা তাদের চারপাশের প্রভাবের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল, যা দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশবে দূষণ বা সীসার সংস্পর্শে আসা শিশুর শিক্ষাগত অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং কিশোর অপরাধ বা সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ে।
ইতিবাচক দিক থেকে দেখা গেলে, শিশুদের জন্য নগদ সহায়তা (যেমন ভাতা, অনুদান বা সরকারি অর্থনৈতিক সহায়তা) শুধু তাদের দারিদ্র্য কমায় না, পাশাপাশি এই সহায়তা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেমন: বড় হয়ে তারা উচ্চশিক্ষায় (বিশ্ববিদ্যালয়ে) ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে এবং প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তাদের আয়ও তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।
২০১৫ সালের এক গবেষণা 'দ্য লং-টার্ম ইফেক্টস অব আর্লি লাইফ মেডিকেড কভারেজ"-এ অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন, গর্ভকালীন সময়ে মেডিকেড সুবিধা পাওয়া মায়েদের সন্তানদের মধ্যে স্থূলতার হার কম, উচ্চ বিদ্যালয় সম্পন্ন করার হার বেশি এবং আয়ও তুলনামূলক বেশি।
গবেষকরা আরও উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ফেডারেল ব্যয়ে প্রবীণদের জন্য প্রতি ৭ ডলার খরচ করা হলেও শিশুদের জন্য ব্যয় মাত্র ১ ডলার। নীতিনির্ধারণে এই প্রবীণ-অগ্রাধিকার প্রবণতাকে তারা 'জেরোন্টোক্রেটিক পক্ষপাত"-বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তাদের মতে, হয়তো এখন সময় এসেছে ওয়াশিংটনের শিশুদের প্রতিও সমান মনোযোগ দেওয়ার।
