একাকী হাঁটার সুখ

কয়েক বছর আগে মস্কোর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমার এক রাশিয়ান সহকর্মী ছিলেন আশির দশকের এক বিদ্রোহী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী। তিনি প্রায়ই বলতেন, তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী কতটা জঘন্য ছিল আর দেশের বেশিরভাগ মানুষ তাদের কী পরিমাণ ঘৃণা করত।
আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেত, একটা সরকার যদি এতটাই অজনপ্রিয় হয়, তাহলে সোভিয়েত ব্যবস্থা এতগুলো বছর টিকল কীভাবে? আমি জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, 'জুলুমের জোরে?' তিনি হেসে বললেন, 'না। আসল কারণটা আরও ভয়ংকর। ভয়ে মানুষ সরকারকে সমর্থনের নাটক করত। ফলে প্রত্যেকেই ভাবত, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস বুঝি শুধু তারই আছে। তাই তারাও ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকত।
কিন্তু শেষে বিদ্রোহীরা মানুষকে বোঝাতে পারল যে, এই শাসকগোষ্ঠীকে ঘৃণা করাই আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত। আর যেই না মানুষ এটা বুঝল, তখনই ক্রেমলিনের খেলা শেষ হয়ে গেল।'যে অদৃশ্য শিকলটি সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণকে এত দিন বেঁধে রেখেছিল, তাকে লেখক ও বিজ্ঞানী টড রোজ বলেছেন 'যৌথ বিভ্রম' (collective illusion)। এটা এমন এক ভুল ধারণা, যেখানে মানুষ ভাবে মনের গভীরে তিনি যা ভাবছেন, তা আসলে আর কেউ ভাবছেন না।
'এই কথাটা বুঝি শুধু আমিই ভাবি!' এমনটা ভাবার ফলে, নির্যাতন বা একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়ে সবাই চুপ থাকে। বিজ্ঞানী রোজ দেখিয়েছেন, এই বিভ্রম শুধু স্বৈরাচারী শাসনকেই টিকিয়ে রাখে না, বরং যেকোনো সমাজকেই গ্রাস করতে পারে, যেখানে 'সবার মতো চলো' ধরনের একটা অদৃশ্য চাপ থাকে। আজকের আমেরিকার কিছু অংশেও আমরা ঠিক এটাই দেখতে পাচ্ছি। যদিও আধুনিক যুক্তরাষ্ট্র আর পুরানো সোভিয়েত ইউনিয়ন এক নয়, কিন্তু এই যৌথ বিভ্রমের প্রক্রিয়া আমাদের গণতন্ত্র আর ব্যক্তিগত সুখ—দুটোকেই ধ্বংস করতে পারে।
এই বিভ্রমের প্রমাণ খোঁজা খুব কঠিন নয়। শুধু মানুষকে জিজ্ঞাসা করলেই হবে, তারা তাদের আসল মতামত প্রকাশ করতে কতটা সামাজিক চাপের মুখে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯,০০০-এরও বেশি নাগরিকের উপর চালানো এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫৮ শতাংশ মানুষ মনে করে যে, 'বেশিরভাগ মানুষই আজ সংবেদনশীল বিষয়ে তাদের মনের কথা খুলে বলতে পারে না,' এবং ৬১ শতাংশ মানুষ স্বীকার করেছে যে তারা আত্ম-নিয়ন্ত্রণে বাধ্য হয়।
এই চাপের কারণেই মানুষ প্রায়ই সেই কথাগুলোই বলে, যা তাদের বন্ধু বা সহকর্মীদের মহলে বেশি গ্রহণযোগ্য, যদিও তাদের আসল বিশ্বাসটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন ধরুন, আমেরিকার আজকের তরুণ প্রজন্ম বা 'জেন জি'-এর ৪৮ শতাংশই কর্মক্ষেত্রে 'লিঙ্গ ও বৈচিত্র্য কোটা'-র পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থন জানায়। কিন্তু যখন তাদের ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাসা করা হলো, তখন দেখা গেল মাত্র ১৫ শতাংশ তরুণ সত্যিই এটা সমর্থন করে! অর্থাৎ, প্রকাশ্যে সমর্থন জানানো প্রায় ৬৯ শতাংশ তরুণই তাদের আসল মতটা চেপে যাচ্ছে।
সমাজের সঙ্গে মানিয়ে চলতে গিয়ে আমরা সবাই তো একটু-আধটু আপোস করি, তাই না? কিন্তু এখানে যে প্রবণতাটি দেখা যাচ্ছে, তা তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুতর। এই আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং যৌথ বিভ্রম আমাদের সমাজে এক ধরনের 'সংখ্যালঘুর স্বৈরাচার' তৈরি করে, যেখানে গুটিকয়েক মানুষের চাপিয়ে দেওয়া মতই যেন সমাজের আইন হয়ে দাঁড়ায়।
এই যে মনের সঙ্গে মুখের লড়াই—এই দ্বন্দ্ব মারাত্মক মনস্তাত্ত্বিক অস্বস্তি তৈরি করে, যা সামাজিক উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার মতো মানসিক রোগের জন্ম দেয়। এটা অনেকটা জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত 'ডাবলথিংক' ধারণার মতো, যেখানে মানুষকে দুটি পরস্পরবিরোধী ধারণা একসঙ্গে মেনে নিতে বাধ্য করে তার মনুষ্যত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।
তাহলে মানুষ কেন যা ভাবে, তা সরাসরি বলে না? কারণ, স্রোতের বিপরীতে কথা বলার ভয়টা আসলে একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়, যা খুবই বেদনাদায়ক। গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক বর্জন আমাদের মস্তিষ্কে শারীরিক আঘাতের মতোই যন্ত্রণা দেয়। অর্থাৎ, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার তীব্র যন্ত্রণা এড়ানোর জন্য মানুষ নিজের বিবেকের সঙ্গে প্রতারণার এই মানসিক যন্ত্রণাটাকেই নীরবে সয়ে যায়।
এই চক্র থেকে বেরোনোর রাস্তা একটাই—নিজের আসল মত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়কে জয় করা। এর জন্য সেরা পথ দেখিয়েছেন দার্শনিক রালফ ওয়াল্ডো এমারসন। তার বিখ্যাত প্রবন্ধ 'আত্মনির্ভরতা' (Self-Reliance) এই বিভ্রম থেকে মুক্তির এক অব্যর্থ টোটকা। এর সারসংক্ষেপ তিনটি ধাপে তুলে ধরা হলো:
১. মিথ্যা বলা বন্ধ করুন:
ভদ্রতার খাতিরে চুপ থাকা এক জিনিস, আর ভয় বা সুবিধার লোভে এমন কিছু বলা যা আপনি বিশ্বাসই করেন না, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমারসনের মতে, এটি এক ধরনের আত্ম-প্রতারণা। তিনি বলেন, 'এই মেকি আতিথেয়তা ও মেকি স্নেহকে ছুঁড়ে ফেলুন।' সত্য বলার জন্য যদি কেউ আপনাকে পছন্দ না-ও করে, তাতে ভয় কীসের?
২. স্বাধীন চিন্তাকে নতুনভাবে দেখুন:
সবার থেকে আলাদা মত দেওয়াটা অবশ্যই কঠিন, ভয়ও লাগে। এমারসন এই ভয়কে নতুনভাবে দেখতে বলেছেন: 'প্রকৃত মহান ব্যক্তি তিনিই, যিনি ভিড়ের মধ্যেও একা থাকার প্রশান্ত স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে পারেন।' তাই প্রত্যাখ্যানকে ভয় না পেয়ে ভাবুন, এটাই আপনার নিজের পথে চলার ছাড়পত্র। আর একাকীত্বকে ভাবুন ভুল জনপ্রিয় মতের কোলাহল থেকে মুক্তি। ভাবাদর্শগত স্বাধীনতাকেই আপনার পরিচয়ে পরিণত করুন এবং মাথা উঁচু করে চলুন।
৩. প্রয়োজনে সরে আসুন:
এর মানে কিন্তু এই নয় যে, আপনাকে আঙুল উঁচিয়ে ঝগড়া করে আসর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আপনার ধারণার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যা প্রয়োজন, তা হলো ভুল বা অগ্রহণযোগ্য চিন্তার উৎস থেকে আপনার মনোযোগ এবং শক্তিকে সরিয়ে নেওয়া। যদি আপনার বন্ধুরা এমন কিছু বলে, যা আপনার মতে অর্থহীন, তবে তাদের সঙ্গে তর্ক করার দরকার নেই। শুধু নীরবে তাদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিন। প্রয়োজনে নতুন বন্ধু খুঁজুন।
গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং আপনার নিজের সুখ বাড়াতে, নিজেকে এই প্রশ্নটি করুন: আপনার কোন ব্যক্তিগত মতামতগুলো আপনি অন্যদের কাছে যা বলেন, তার থেকে ভিন্ন? এরপর, একটা তালিকা বানান আর ঠিক করুন কীভাবে এই ভুল ধারণার থেকে নীরবে নিজের স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কিছু ক্ষেত্রে, আপনি হয়তো দেখবেন যে যাকে আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠের মত ভাবছিলেন, তা আসলে একটি যৌথ বিভ্রম ছিল, এবং আপনিই হয়তো সেই বিভ্রম ভাঙার কারণ হবেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে, আপনি দেখবেন যে আপনি সত্যিই সংখ্যালঘু, এবং আপনাকে একাই চলতে হবে। চলুন না! একলা চলার আনন্দ তো সেখানেই।