জনস্বাস্থ্য উদ্ভাবনে বিনিয়োগ: বাংলাদেশের জন্য সময় এখনই

বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প একটি নীরব সাফল্যের গল্প। দেশটি সাশ্রয়ী মূল্যের জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন করে। এর মাধ্যমে নিজ ও উন্নয়ন বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের সেবা করছে। এদেশের ওষুধ শিল্প খাত ইতোমধ্যে দেশীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করছে। রপ্তানি করছে ১৫০টিরও বেশি দেশে। এই রপ্তানির আর্থিক মূল্য প্রায় ১৬৯ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এটি মূল ওষুধ আবিষ্কারে বিনিয়োগকারী দেশগুলোর তুলনায় খুবই কম। উপরন্তু, বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে উত্তরণের দিকে এগোচ্ছে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে উত্তরণের পর এদেশের ওষুধ শিল্প খাত ট্রিপস চুক্তির অধীনে নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি বাধ্যবাধকতার মুখোমুখি হবে। এর ফলে আমদানি করা ওষুধের খরচ বাড়বে।
এমনই বাস্তবতায় জেনেরিক উৎপাদন কেন্দ্র থেকে ওষুধ উদ্ভাবক দেশে পরিণত হওয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। আর উঠে আসছে একটি মৌলিক প্রশ্ন: বাংলাদেশ কি আদৌ জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনকারীর ভূমিকা থেকে বিশ্ব ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণায় একটি প্রকৃত উদ্ভাবক হতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তরেই নিহিত আছ দেশীয় গবেষণা সক্ষমতা বিকাশ ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার বিষয়টি। সক্ষমতার এই বিকাশ দেশের জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতির ভিতকে জোরদার করবে।
সাধারণত ওষুধ আবিষ্কারকে একটি জটিল প্রক্রিয়া মনে করা হয়। ধরেই নেওয়া হয়, কেবল ধনী দেশগুলোর পক্ষেই ওষুধ উদ্ভাবনে বিনিয়োগ সম্ভব। বাস্তবে এর পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ও ধাপের অনেকগুলোই বাংলাদেশের নাগালের মধ্যে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় একটি জৈবিক লক্ষ্য চিহ্নিত করার মাধ্যমে। এই পর্যায়ে গবেষকরা বিশেষ কোনো রোগের সাথে সম্পর্কিত কোনো প্রোটিন বা পথ চিহ্নিত করেন। হাজার হাজার যৌগ যাচাই-বাছাই খুঁজে বের করেন কাঙ্ক্ষিত যৌগটি। তারপর খতিয়ে দেখেন এর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি। এরপর যৌগগুলোকে ল্যাবরেটরি মডেলে প্রাক-ক্লিনিকাল পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষার পর মানুষের ওপর ক্লিনিকাল ট্রায়ালের তিনটি পর্যায় হয়। এই পর্বে নিশ্চিত করা হয় নিরাপত্তা, কার্যকারিতা এবং তুলনামূলক কার্যকারিতা। অবশেষে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন শেষে বাজারে ছাড়া হয় নতুন ওষুধ। একটি সফল ওষুধের জন্য কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে। খরচ হয় অন্তত এক থেকে দুই বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো কৌশলগতভাবে নির্দিষ্ট পর্যায়ে অংশগ্রহণ করতে পারে।
বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদন খাত ইতোমধ্যেই শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। দেশে ২০০টিরও বেশি কোম্পানি ১৫,০০০টিরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করছে। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছর আনুমানিক ২,৫০০ জন ফার্মেসি স্নাতক তৈরি করছে। এতে দক্ষ পেশাজীবীদের একটি বর্ধমান পুল তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এবং বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে।
তবে এখন পর্যন্ত এটি মূলত জেনেরিক ফর্মুলেশনের উপর কেন্দ্রীভূত। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল বাংলাদেশের অবহেলিত ট্রপিক্যাল রোগ মোকাবিলার সম্ভাবনা রয়েছে। এই রোগগুলো দক্ষিণ এশিয়ার লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করে। কিন্তু সীমিত লাভের সম্ভাবনার কারণে বিশ্বের বড় ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্টদের কাছ থেকে সামান্য মনোযোগ পায়। বাংলাদেশ এই উদ্ভাবনের ফাঁক পূরণ করতে পারে। একইসাথে গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারে।
ওষুধ উদ্ভাবনের পথে বাধা নেই এমন নয়। ওষুধ আবিষ্কারের জন্য বিশেষায়িত সরঞ্জাম, ল্যাবরেটরি অবকাঠামো এবং স্থায়ী গবেষণা অর্থায়নে উল্লেখযোগ্য মূলধন বিনিয়োগের প্রয়োজন। বর্তমানে বার্ষিক প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের ওষুধ উৎপাদন করলেও এদেশের কোম্পানিগুলো গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ রাজস্বের এক শতাংশেরও কম। অথচ এ খাতে তাদের বিনিয়োগ করা উচিত ১৫-২০ শতাংশ।
কারিগরি দক্ষতা আরেকটি বাধা। অনেক ফার্মেসি স্নাতক তৈরি করা সত্ত্বেও, বাংলাদেশে মেডিসিনাল কেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি এবং কম্পিউটেশনাল ড্রাগ ডিজাইনে উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এগুলো ওষুধ আবিষ্কারের জন্য মূল যোগ্যতা। দেশের নিয়ন্ত্রক পরিবেশ উন্নত হচ্ছে। কিন্তু জটিল গবেষণা কার্যক্রম তদারকি ও আন্তর্জাতিক মান পালন নিশ্চিত করতে আরও উন্নয়নের প্রয়োজন।
বৌদ্ধিক সম্পত্তি বিবেচনাও বড় হয়ে দেখা দেয়। উদ্ভাবন পেটেন্টকে সম্মান করা এবং জনস্বাস্থ্য স্বার্থ রক্ষা করা-এর মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
এই চ্যালেঞ্জগুলো সত্ত্বেও সুযোগগুলো আকর্ষণীয়। ওষুধ আবিষ্কারে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ফার্মাসিউটিক্যাল উদ্ভাবনের নেতা হিসেবে জায়গা করে নিতে পারে। জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনে ভারত বিশ্বের অন্যতম পাওয়ারহাউস। তবে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে একটি আঞ্চলিক ফাঁক বিদ্যমান। কাজেই বাংলাদেশ এই সুযোগ নিতে পারে। জেনেরিক উৎপাদনের বাইরে একটি নতুন রাজস্ব স্রোত তৈরি করতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বাংলাদেশ তার জনসংখ্যার জেনেটিক গঠন এবং রোগের ধরন বোঝার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলেতে পারে। ভূগর্ভস্থ পানির দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রচলিত আর্সেনিক-সম্পর্কিত রোগগুলো স্থানীয়ভাবে লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করে। কিন্তু এসব সমস্যা বিশ্বব্যাপী গবেষণা মনোযোগ পায় সামান্য। দেশীয় গবেষণা এই অবহেলিত স্বাস্থ্য অগ্রাধিকারগুলো মোকাবিলা করতে পারে। একইসাথে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য পণ্য তৈরি করতে পারে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়ন করতে কৌশলগত নীতি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। প্রথমত, বাংলাদেশের একটি নিবেদিত ফার্মাসিউটিক্যাল ইনোভেশন ফান্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে পাবলিক-প্রাইভেট গবেষণা অংশীদারিত্ব। সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে সরকার ও শিল্প থাতের মাঝে। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রকট রোগের ওষুধ আবিষ্কারে মনোযোগ দিতে হবে। এতে প্রুফ-অফ-কনসেপ্ট সাফল্য তৈরি হবে, যা আরও বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে।
দ্বিতীয়ত, একাডেমিয়া-ইন্ডাস্ট্রি সহযোগিতা কাঠামো অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাণিজ্যিক সম্ভাবনাসহ প্রয়োগমূলক গবেষণা পরিচালনার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। এজন্য একাডেমিক গবেষণায় অর্থায়ন ও উন্নত ডিগ্রি শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টার্নশিপ প্রদানের জন্য ওষুধ কোম্পানিগলোকে ট্যাক্স সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।
তৃতীয়ত, নৈতিক মান বজায় রেখে গবেষণা অনুমোদন সহজতর করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্কার করতে হবে। উদ্ভাবনী গবেষণার জন্য একটি স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এতে আমলাতান্ত্রিক বাধা কমবে। একইসাথে, দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন সময়োপযোগী করতে হবে। এতে উদ্ভাবনের জন্য যুক্তিসংগত স্বার্থ নিশ্চিত করা যাবে।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত গবেষণা কেন্দ্রগুলোর সাথে কৌশলগত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অনুসরণ করতে হবে। উন্নত দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগ জ্ঞান হস্তান্তর ত্বরান্বিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদাররা গবেষণা অবকাঠামো এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রতিষ্ঠায় কারিগরি সহায়তা প্রদান করতে পারে।
স্বাধীনতা থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নয়নের কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে কৃষিনির্ভরতা থেকে গার্মেন্ট উৎপাদন, গ্রামীণ জীবনযাপন থেকে শহুরে উন্নয়নের প্রতি মনোযোগ রেখে। কিন্তু আজ এদেশের ওষুধশিল্প খাত পরবর্তী বড় রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত।
২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণা ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে পারে। কিছু ওষুধ, থেরাপি কিংবা ভ্যাকসিন বিকাশ ঘটাতে পারে। যা আঞ্চলিক স্বাস্থ্য অগ্রাধিকারগুলো মোকাবিলা করতে সাহয্য করবে। এছাড়াও কর্মসংস্থান হবে হাজার হাজার মেধাবী বিজ্ঞানীর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি করতে পারে উদ্ভাবন নেতৃত্ব দিতে সক্ষম বিশেষায়িত প্রতিভা। বাড়তে পারে ফার্মাসিউটিক্যাল রপ্তানির বর্তমান মূল্যের দশগুণ।
ওষুধ উদ্ভাবনে এই বিনিয়োগ কেবল একটি অর্থনৈতিক সুযোগ নয়। বরং এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলাদেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে এমন স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার সুযোগ। আজ ওষুধ আবিষ্কারে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ বিশ্ব উদ্ভাবন অর্থনীতিতে তার স্থান নিশ্চিত করতে পারে। একইসাথে জনগণের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ উন্নত করার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে।
তবে পথটি সহজ হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে সবচেয়ে বড় জাতীয় অর্জনগুলো কখনোই সহজ হয় না। বাংলাদেশের এখন ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ থেকে ওষুধ আবিষ্কার করে এমন দেশে রূপান্তরিত হওয়ার সময় এসেছে।
- মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম: জনস্বাস্থ্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র লেকচারার, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)