অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জর্জরিত স্বাস্থ্য খাত: নকল-ভেজাল ওষুধে বিপন্ন জনস্বাস্থ্য

মাত্র ৫০০ টাকার বকশিশ না পেয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। শ্বাসকষ্টে ভর্তি রোগী শেখ সাইফুল ইসলাম (৩৮)-এর অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেয় হাসপাতালের ক্লিনার আব্দুল জব্বার। অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাইফুল ছটফট করতে করতে ১৫ মিনিটের মধ্যে মারা যান। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে এ তথ্য প্রকাশ পেলে হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়, ক্লিনার ও প্রশাসনের অমানবিক এই আচরণে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
এর আগে, ২০২৩ সালে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতাল ও মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে দুই শিশু আয়ান আহমদ ও আহনাফ তাহমিদ খৎনার সময় অচেতন করার পর মারা যায়। একই বছরে চট্টগ্রামেও সিজার অপারেশনে নকল চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগে কয়েকজন প্রসূতির মৃত্যু ঘটে। তদন্তে জানা যায়, ভারত থেকে লাগেজ পার্টির মাধ্যমে আনা নকল 'হ্যালোথেন' ইনজেকশন ও হাসপাতালের অব্যবস্থাপনাই এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সব ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভারতীয় হ্যালোথেন ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
জীবন রক্ষাকারী ওষুধই যদি নকল বা ভেজাল হয়, তবে তা মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে; এ কথা বহুবার প্রমাণিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিম্নমানের বা ভেজাল ওষুধ ব্যবহারে মৃত্যুর নজির রয়েছে।
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ভারতের মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে 'কোল্ডরিফ' নামের কফ সিরাপ সেবনে কিডনি বিকল হয়ে বেশ কিছু শিশুর মৃত্যু হয়। সিরাপে নিষিদ্ধ রাসায়নিক ডাই-ইথিলিন গ্লাইকোল মেশানো হয়েছিল বলে তদন্তে জানা যায়। এই সিরাপের উৎপাদনকারী তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরামের মেসার্স শ্রী চাঁন ফার্মাসিউটিক্যালস-এর সব উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম স্থগিত করে রাজ্য সরকার। এর আগে, ২০২২ সালে ভারতের হরিয়ানার মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালস-এর উৎপাদিত একই ধরনের কফ সিরাপ সেবনে গাম্বিয়ায় ৭০ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল।
বাংলাদেশও এই বিপর্যয়ের বাইরে নয়। ১৯৯১ সালে ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে ৭৬ শিশুর মৃত্যু ঘটে; দেশে ভেজাল ওষুধে এটি ছিল সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। পরে ২০০৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রিড ফার্মাসিউটিক্যালসের উৎপাদিত সিরাপ খেয়ে আরও ২৮ শিশুর মৃত্যু হয়। মোট ১০৪ শিশুর মৃত্যুর তদন্তে দেখা যায়, এসব সিরাপে সস্তা কিন্তু বিষাক্ত রাসায়নিক ডাই-ইথিলিন গ্লাইকোল মেশানো হয়েছিল—যা কাঠের বার্নিশে ব্যবহৃত হলেও ওষুধে ব্যবহারের অনুমোদন নেই।
প্রশ্ন জাগে, আর কত মায়ের বুক খালি হলে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে এই বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ হবে? জীবনরক্ষাকারী ওষুধের মান নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা কেমিস্ট, ফার্মাসিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কি আরও দায়িত্বশীল হবেন না? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য দেশি-বিদেশি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কি এখনই কার্যকর ফার্মাকোভিজিল্যান্স ব্যবস্থা নেবে না—যাতে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধে আর কোনো শিশুর মৃত্যু না ঘটে?
দুর্নীতি আজ দেশের প্রতিটি রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, প্রশাসন—কোথাও এর ব্যতিক্রম নেই। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী দুর্নীতি দমন কমিশনের ব্রিফিং ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো প্রমাণ করে, কিভাবে বিগত আওয়ামী সরকারের ক্ষমতাসীনরা ব্যাংক দেউলিয়া করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে—যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে।
স্বাস্থ্য খাতও এই দুর্নীতির মহোৎসব থেকে বাদ যায়নি। গত ১৬ বছরে তারা প্রকল্পে অনিয়ম, টেন্ডার জালিয়াতি, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহসহ নানা অপকর্মে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে।
ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ ও বিপণনের প্রতিটি ধাপে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে—এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের ওষুধ বাজারের আকার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে ৯১৩টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে—এর মধ্যে ৩১০টি অ্যালোপ্যাথিক, ২৮৬টি ইউনানী, ২০৭টি আয়ুর্বেদিক, ৭১টি হোমিও ও ৩৯টি হার্বাল কোম্পানি। তারা দেশের ৯৮ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে এখন ১৬০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে।
অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের অধিকাংশ কাঁচামাল ভারত ও চীন থেকে, বাকিগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয়। তবে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ইউরোপীয় কাঁচামালের ট্যাগ লাগিয়ে নিম্নমানের উপকরণ বাজারে বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
ইউনানী, আয়ুর্বেদ, হোমিও ও হার্বাল ওষুধ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরির বাধ্যবাধকতা থাকলেও কিছু লোভী কোম্পানি রাসায়নিক মিশিয়ে ভেজাল ওষুধ তৈরি করছে—এমন অভিযোগ নতুন নয়। ন্যাশনাল ড্রাগ কন্ট্রোল ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় এসব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে।
সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করে, কিন্তু অসাধু চিকিৎসক, ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারীদের যোগসাজশে সেই ওষুধের বড় অংশ কালোবাজারে বিক্রি হয়ে যায়। ফলে সাধারণ মানুষকে নিজ খরচে ওষুধ কিনতে হয়। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ শতাংশই জনগণকে ওষুধ কিনতে ব্যয় করতে হয়।
এর পাশাপাশি নকল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদকদের দৌরাত্ম্যও ভয়াবহ। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের বিসিক শিল্প এলাকায় ইস্ট বেঙ্গল ইউনানী নামের একটি কোম্পানিতে রেনিটিডিন, প্যারাসিটামল ও ভায়াগ্রা জাতীয় নকল ওষুধ উৎপাদনের সময় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর তাদের হাতে-নাতে ধরে ফেলে। এর আগে চুয়াডাঙ্গার ওয়েস্ট ল্যাবরেটরিজ (আয়ু) নামের প্রতিষ্ঠানেও নকল ওমিপ্রাজল, মন্টিলুকাস্ট, ন্যাপ্রোক্সেনসহ বিভিন্ন অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরি করার সময় ধরা পড়ে। ইউনানী বা আয়ুর্বেদিক লাইসেন্সে এসব জীবনরক্ষাকারী অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ উৎপাদনের দায়ে উভয় কোম্পানির বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর ২৫(সি) ধারায় মামলা চলছে।

মানসম্মত ওষুধ উৎপাদনে প্রয়োজন দক্ষ জনবল, বিশুদ্ধ কাঁচামাল, আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত পরিবেশ। উৎপাদন, মাননিয়ন্ত্রণ, বিপণন খরচ এবং প্রতিষ্ঠানের লাভ যোগ করে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে ১১৭টি জেনেরিক ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করে, বাকিগুলোর—বিশেষত অ্যান্টিবায়োটিক ও উচ্চমূল্যের ওষুধের—দাম ঠিক করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো।
ডাক্তারদের ফ্ল্যাট, গাড়ি, বাড়ি, বিদেশ ভ্রমণসহ নানা উপহার দিয়ে ওষুধ প্রেসক্রাইব করানো—এমন অভিযোগ বহু পুরনো। এর খেসারত দিতে হয় সাধারণ জনগণকে, কারণ এই বাড়তি ব্যয় গুনতে হয় ওষুধের মূল্যেই। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, এই অনৈতিক প্রথা বন্ধ করা গেলে ওষুধের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসবে। তাই স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন উন্নত বিশ্বের আদলে ডাক্তারদের জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা জাতির শত্রু। মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করে তারা স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া ডনে পরিণত হয়েছে, দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে।
২০২৩ সালের 'ওষুধ ও কসমেটিকস আইন' অনুযায়ী, নকল বা ভেজাল ওষুধ উৎপাদন বা বিপণনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, অথবা ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, কিংবা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা—বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু দুই বছর পার হলেও এই আইনে কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়নি।
স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করতে হলে কঠোর আইনি প্রয়োগ এবং স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। তা বাস্তবায়ন করা গেলে, বাংলাদেশেও একদিন গড়ে উঠবে বিশ্বমানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা—এমনটাই মনে করেন সচেতন মহল।
লেখক: সাবেক উপ-পরিচালক ও আইন কর্মকর্তা,
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ঢাকা।