রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে রবীন্দ্রবিরোধী প্রকল্প বন্ধ করো, চলনবিলের গোচারণ ভূমি বাঁচাও
একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রশংসনীয় হতে পারে। তবে সেই সিদ্ধান্ত যদি মানুষের জীবিকা, প্রকৃতি এবং ইতিহাসের ক্ষতির বিনিময়ে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে সেটিকে উন্নয়ন বলা চলে না। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের চলনবিল অঞ্চলের বাথানভূমিতে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের উদ্যোগ ঠিক এমনই একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ, যা একটি বাস্তুতন্ত্র, একটি অর্থনীতি এবং একটি শতবর্ষ পুরনো জনকল্যাণমূলক ঐতিহ্যের ওপর সরাসরি আঘাত হানছে।
চলনবিলকে অনেকে কেবল একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র মনে করেন, অথচ বাস্তবে এটি নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জজুড়ে বিস্তৃত একটি জলাভূমি ব্যবস্থা। শাহজাদপুরের চারণভূমিও এই ব্যবস্থারই অংশ। অর্থাৎ, প্রস্তাবিত প্রকল্পের স্থানও বিলের মৌসুমি জলচক্র ও প্রাকৃতিক প্রবাহের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। চলনবিল শুধু গবাদিপশুর চারণভূমি নয়, বরং এটি বাংলাদেশের অন্যতম বড় মিঠাপানির মাছের আধারও।
বর্ষায় বিলের বিস্তীর্ণ জলাভূমি মাছের প্রজননক্ষেত্র ও আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে, যেখানে হাজারো জেলে পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। আর শুষ্ক মৌসুমে জমিতে বোরো ও কলাই চাষের পাশাপাশি গবাদিপশুর জন্য ঘাস উৎপাদন করা হয়। এভাবে চলনবিল দেশের প্রাণীজ আমিষের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করছে।
প্রায় ১৫০০ একর বিস্তৃত এই এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৩০ হাজারের বেশি গোখামার রয়েছে, যেখানে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। দুধ সংগ্রহ, পরিবহন, পশুখাদ্য ও ওষুধ বিক্রিসহ নানা কাজেও আরও বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। এখানকার দুধ সরবরাহ হয় মিল্কভিটাসহ দেশের বড় বড় দুগ্ধপ্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায়। ফলে এই গোচারণভূমি শুধু একটি প্রাকৃতিক ক্ষেত্র নয়, বরং এটি শাহজাদপুর তথা বাংলাদেশের অন্যতম দুগ্ধভিত্তিক অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র।
এই জমির রয়েছে এক অসাধারণ মানবিক ইতিহাস। ১৯০৩ সালে এক গোয়ালা কৃষকের আর্থিক অসুবিধার কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই জমির একটি বড় অংশ গরু চরানোর জন্য চিরস্থায়ীভাবে দান করেন। সেই থেকে এই বিশাল এলাকা বাথানভূমি নামে পরিচিত।
উল্লেখ্য, কৃষকেরা মাঠের ফসল পাহারা দেওয়া এবং পশু পালনের জন্য যে অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ করেন, সেটার নামই বাথান। শুধু যে গোচারণের জন্য জমি দিয়েছেন তা নয়, ভালো উন্নত শাহিওয়াল জাতের ষাঁড় এনে গাভি প্রজননের মাধ্যমে উন্নত গো-সম্পদ সৃষ্টির ব্যবস্থা করেছিলেন। এই দান ছিল সমাজভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থাকে সম্মান জানানো এবং কৃষিজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়নের এক নিদর্শন। সেই জমিতেই এখন তার নামেই নির্মাণ করা হচ্ছে স্থায়ী স্থাপনা, যেখানে তার মানবিক দর্শনের ছিটেফোঁটাও প্রতিফলিত হচ্ছে না।
২০১৬ সালে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইন পাস হয়। ২০১৮ সালে চলনবিল অঞ্চলের এই চারণভূমির মধ্য থেকে ১০০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য। ২০২৫ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রায় ৫১৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করে, যার আওতায় রয়েছে প্রশাসনিক ভবন, অ্যাকাডেমিক ভবন, ডরমিটরি, লেক, বৃক্ষরোপণ ও ৭ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসন পরিকল্পনা। অথচ প্রকল্পের জন্য এখনও পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়া যায়নি।
আশঙ্কার বিষয় হলো, এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলে তা শুধু কয়েকটি ভবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পুরো এলাকাজুড়ে এক ধরনের ক্যাম্পাস-নগরায়ন শুরু হবে। প্রথমে ছাত্রদের জন্য ভাড়া-বাড়ি, খাবারের দোকান, স্টেশনারি ও ফটোকপি সেন্টার গড়ে উঠবে, পরে যুক্ত হবে ফার্মেসি, ক্লিনিক, মিনি-সুপারশপ, কোচিং সেন্টার ও রিয়েল এস্টেট অফিস।
এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় স্টুডেন্টিফিকেশন, যেখানে শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক ব্যবসা ও আবাসনের বিস্তার ঘটে এবং ধীরে ধীরে পুরো এলাকা এক সার্ভিস-ইকোনমি টাউন এ রূপ নেয়।
এর ফলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ হাজার শিক্ষার্থী নয়, বহিরাগত আরও বিপুল মানুষ এই এলাকায় বসতি স্থাপন করবে ও জমি কিনবে। পরিকল্পনাহীন এই নগরায়ণ জলাভূমি ও চারণভূমিকে কংক্রিটে ঢেকে দিয়ে চলনবিলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। শুধু যে গবাদিপশু চরানোর জায়গা হারাবে তা নয়, বরং কৃষিজমি, মাছের আবাসস্থল ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্যও এক ভয়াবহ হুমকি তৈরি করবে।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো, যে কবি নিজের জমি মানুষের জীবিকার জন্য দান করেছিলেন, তার নামেই আজ সেই জমি দখল করা হচ্ছে। এই প্রকল্প কোনোভাবেই রবীন্দ্রনাথের আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বরং এটি রবীন্দ্রচেতনার বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়। তাই এটিকে রবীন্দ্রবিরোধী প্রকল্প বলা ছাড়া আর কোনো ভাষা যথাযথ হয় না।
আরও গভীরতর উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্ত এসেছে এমন এক সময়, যখন জনগণ মাত্রই পতিত স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক পরিবর্তনের আশা করছে। চলমান সরকার এই গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত। অথচ সেই সরকার পুরনো শাসনের ধারা ধরে রেখেই প্রকৃতি, জীবন ও জনগণের ওপর কর্পোরেট উন্নয়নের নামে চাপিয়ে দিচ্ছে একের পর এক সিদ্ধান্ত। এটি জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং রাজনৈতিকভাবে এক প্রকার বিশ্বাসঘাতকতা।
বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের প্রয়োজন। শিক্ষার পরিসর বাড়ানো জরুরি। কিন্তু সেটি এমনভাবে হওয়া উচিত নয়, যা জীবিকা, প্রকৃতি এবং ইতিহাসকে মুছে দেয়। সরকার চাইলে চলনবিলের বাইরের অনাবাদি খাসজমি, শহরতলির সংযুক্ত সরকারি জমি বা অন্য কোনো পরিবেশবান্ধব জায়গায় এই প্রকল্প স্থানান্তর করতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধা বাড়বে এবং প্রকৃতি ও কৃষিজীবী মানুষও বাঁচবে।
আমরা এই প্রকল্প বাতিলের আহ্বান জানাই। শাহজাদপুরের এই গোচারণ ভূমি 'সংরক্ষিত চারণ এলাকা' হিসেবে ঘোষণা করা হোক। চাইলে এখানে একটি 'রবীন্দ্র পশুপালন ও পরিবেশ গবেষণা কেন্দ্র' স্থাপন করা যেতে পারে, যা রবীন্দ্র দর্শনের সত্যিকার চর্চা হবে এবং এলাকাবাসীর জীবিকার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, 'প্রকৃতির ওপর দয়া করো, সে তোমার সহোদরা'। আজ সেই সহোদরার বুকেই ইট-বালু চাপানো হচ্ছে। আমরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছি, শুধু ইতিহাস নয়, ভবিষ্যতের জীবন ও প্রকৃতি রক্ষার দায়ে।
আমাদের দাবিগুলো
১. রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ প্রকল্প অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। কারণ এটি চলনবিলের জীবন্ত গোচারণ ভূমি ও জলাভূমি ধ্বংস করছে।
২. চলনবিলের বাথানভূমিকে 'সংরক্ষিত চারণ এলাকা' ঘোষণা করতে হবে, যাতে কৃষক, ঘোষ, দুগ্ধ খামারি, জেলে ও সংশ্লিষ্ট লাখো মানুষের জীবিকা নিরাপদ থাকে।
৩. রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিকল্প জমি নির্ধারণ করতে হবে—অনাবাদি খাসজমি বা শহরতলির সরকারি জমি, যেখানে পরিবেশ বা জীবিকা বিপন্ন হবে না।
৪. পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধ করতে হবে—চলনবিলের জলপ্রবাহ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের আগে পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ মূল্যায়ন জরুরি।
৫. নগরায়ণের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার রুখতে হবে—বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক দোকান, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে 'ক্যাম্পাস-নগরায়ন' ও 'স্টুডেন্টিফিকেশন' ঘটবে, তা চলনবিলের জন্য ভয়াবহ হবে। তাই পরিকল্পনাহীন দখল রোধে সুনির্দিষ্ট নীতি নিতে হবে।
৬. রবীন্দ্র দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উদ্যোগ নিতে হবে—চারণভূমি ধ্বংস না করে এখানে 'রবীন্দ্র পশুপালন ও পরিবেশ গবেষণা কেন্দ্র' গড়ে তোলা যেতে পারে, যা কৃষক ও পরিবেশের জন্য সহায়ক হবে।
৭. গণআকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে—জনগণের আত্মত্যাগে পতিত স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটেছে। সেই প্রেক্ষাপটে নতুন সরকারের উচিত জনস্বার্থ ও প্রকৃতির পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া, কর্পোরেট দখল ও পরিবেশ ধ্বংসের ধারাবাহিকতা নয়।
