ঋণাত্মক আবেগ ও অর্থব্যয়ের মনস্তত্ত্ব—নীরব, কিন্তু গভীরভাবে সংযুক্ত

প্রতিদিনের জীবনে আমরা নানা রকম আবেগের মধ্য দিয়ে চলি—আনন্দ, কষ্ট, হতাশা, রাগ, ভয়, দুঃখ কিংবা শূন্যতা। এই আবেগগুলোর প্রতিক্রিয়া কেবল আমাদের মানসিক অবস্থাকেই প্রভাবিত করে না, বরং আমাদের আর্থিক সিদ্ধান্তের উপরেও সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে যখন আবেগ হয় ঋণাত্মক, তখন অনেক সময় আমরা অবচেতনভাবে এমন কিছু খরচ করি, যেগুলোর প্রয়োজন হয়তো ছিল না বা যেগুলো আমাদের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক লক্ষ্যকে বিঘ্নিত করে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে জীবনযাত্রার চাপ, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক তুলনা প্রায় সবসময়ই মানুষের উপর মানসিক চাপ তৈরি করে, সেখানে এই ঋণাত্মক আবেগ-নির্ভর খরচের প্রবণতা আরও চোখে পড়ার মতো। অনেক সময় মানুষ বুঝেই উঠতে পারে না, কেন সে হঠাৎ নতুন ফোন কিনে ফেললো, কেন অনলাইনে ডিসকাউন্ট দেখে অপ্রয়োজনীয় জিনিস অর্ডার করলো, কিংবা কেন বিকেলে মন খারাপ থাকলে পাঁচশ টাকা দিয়ে প্রিয় রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়াটা জরুরি মনে হলো।
এ ধরনের আচরণগুলোকে অর্থনীতিবিদ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলেন 'ইমোশনাল স্পেন্ডিং' বা 'আবেগজনিত ব্যয়'।
সাধারণত যখন আমরা হতাশ, একা, বিরক্তবোধ করি বা আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগি—তখন মস্তিষ্ক একটি তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টির খোঁজ করে। আর এই সন্তুষ্টি আমরা অনেক সময় খুঁজে পাই খরচ করার মধ্যে—নতুন কিছু কেনার মধ্যে, খাবার অর্ডার করার মধ্যে, কিংবা প্রিয় কিছু উপভোগ করার মধ্যে।
কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় তখন, যখন এই খরচটা হয়ে ওঠে একটি চক্র। একবার যখন আমরা দুঃখ বা বিষণ্ণতায় পড়ে কিছু কিনে ফেলি, তখন সাময়িক একটা আনন্দ পাওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু তারপরে যদি অনুশোচনা হয়, যদি মনে হয় 'প্রয়োজন ছিল না, টাকা নষ্ট করলাম'—তখন আবার সেই হতাশাই ফিরে আসে। আর এই চক্রই ধীরে ধীরে গড়ে তোলে একধরনের অস্থির ব্যয়-আচরণ।
এই প্রবণতা কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক মাধ্যমগুলোও এই আবেগকে কাজে লাগায়। আজকাল ফেসবুক, ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রামে এমনভাবে 'স্পন্সরড' কনটেন্ট ও বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, যা আমাদের আবেগকে স্পর্শ করে।
যেমন—আপনি যদি কিছুদিন ধরে একা থাকেন বা মন খারাপ থাকে, তখন হয়তো আপনাকে দেখানো হবে 'সেলফ কেয়ার' পণ্যের বিজ্ঞাপন, যেখানে বলা হবে—'নিজেকে ভালোবাসুন, একটা পারফিউম কিনুন', অথবা—'আপনার তো একটু আনন্দের অধিকার আছে, এই ডিসকাউন্ট মিস করবেন না'।
এই আবেগঘন মার্কেটিং আমাদের অনেক সময় এমন কিছু খরচে উস্কে দেয়, যা আমরা বাস্তবিক চাহিদার ভিত্তিতে নয়, বরং মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় করি। কেউ কেউ বলেন, এটা একধরনের 'ইমোশনাল এনেসথেসিয়া' বা মানসিক ব্যথার ওপর সাময়িক ব্যান্ডেজ।
বিশেষ করে চাকরিহীনতা, পরীক্ষায় ভালো না করা, সম্পর্কের ভাঙন বা পারিবারিক ঝামেলার মতো সময়গুলোতে আমরা আর্থিকভাবে আরও বেশি দুর্বল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। কারণ তখন যুক্তি নয়, আবেগ চালায় আমাদের। আমাদের মস্তিষ্ক মনে করে, নতুন জামাকাপড় বা গ্যাজেট কিনলে হয়তো আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে, বা দামী কফিশপে গিয়ে একাকীত্ব ভুলে থাকা যাবে। অথচ এই ক্ষণস্থায়ী প্রশান্তির পেছনে যায় আমাদের সঞ্চয়, নষ্ট হয় অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা।
বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি আরও জটিল কারণ, এখানে অর্থনৈতিক শিক্ষার অভাব রয়েছে। আমরা শিখি না কীভাবে বাজেট তৈরি করতে হয়, কীভাবে মানসিক চাপ সামলাতে হয় বা কীভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হয়। ফলে আবেগ ও অর্থ একত্রে মিশে গিয়ে এমন এক চিত্র আঁকে, যেখানে মধ্যবিত্ত বা তরুণ চাকরিজীবীরা মাসের শেষে না বুঝেই দেনায় জড়িয়ে যান।
অনেক সময় দেখা যায়, কেউ হয়তো দুঃখ বা হতাশা থেকে কার্ডে কেনাকাটা করে, পরে তা মাস শেষে পরিশোধ করতে না পারায় উচ্চ সুদে ঋণের মধ্যে পড়ে যান। এর ফলে আবার নতুন চাপ তৈরি হয়, এবং এই চাপ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে তিনি আবার খরচ করেন—এটি যেন এক বিষাক্ত চক্র।
এই চক্র থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রথম ধাপ হলো—আত্মসচেতনতা। নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার—আমি কি সত্যিই এই জিনিসটা প্রয়োজনের জন্য কিনছি, নাকি কেবল একরকম অনুভূতি সামলাতে চাইছি? যদি বুঝতে পারি যে আমি মানসিক চাপের কারণে ব্যয় করছি, তাহলে সেটি থামানো দরকার। বিকল্প কিছু করা যেতে পারে—বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা, একটু হাঁটাহাঁটি করা, বই পড়া বা জার্নাল লেখা। এসব অভ্যাস খরচ না করে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেয়।
দ্বিতীয়ত, নিজের জন্য একটি মানসিক ও আর্থিক সীমানা নির্ধারণ করা জরুরি। আপনি যদি জানেন, মাসে ১,০০০ টাকার বেশি 'অপ্রয়োজনীয় খরচ' করবেন না, তাহলে সেখানেই থামতে পারবেন। এক্ষেত্রে 'সচেতন খরচ' (মাইন্ডফুল স্পেন্ডিং) চর্চা করা ভালো।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—মানসিক স্বাস্থ্য এবং আর্থিক শৃঙ্খলার মধ্যে সম্পর্ক বোঝা। আপনি যতই সঞ্চয়পটু হন, যদি আবেগ আপনাকে বারবার দুর্বল করে দেয়, তাহলে সেই অর্থ জমে থাকলেও আপনার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত থাকবে। আবার যদি আবেগকে বুঝতে পারেন, নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাহলে আপনি খরচের দাস হয়ে যাবেন না, বরং নিজের অর্থনৈতিক জীবনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন।
আমাদের পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজকেও এই বিষয়ে সংবেদনশীল হতে হবে। কারণ, আবেগজনিত ব্যয় আজ একটি ব্যক্তিগত বিষয় নয়, বরং এটি অর্থনীতির অদৃশ্য অথচ গভীর প্রভাবক। এই প্রবন্ধটি যদি আপনাকে একটিবার চিন্তা করায়—আপনার পরবর্তী খরচটা কীভাবে আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, তবে এ লেখার সার্থকতা পূর্ণ হবে।
- লেখক : কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট অ্যান্ড সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।