শরীরের পানির চাহিদা ঠিকমতো পূরণ হচ্ছে কি? মূত্রের দিকে নজর রাখলেই মিলবে উত্তর

দৈনন্দিন পানি পানের অভ্যাস কতটা সঠিক, তা বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি হলো মূত্রের দিকে নজর রাখা।
ভাবুন তো, কোনো একদিন রোদের মধ্যে থেকেও তেমন পানি পান করা হলো না। পরদিন সকালে, পর্যাপ্ত ঘুমের পরেও শরীরজুড়ে ক্লান্তি, খিটখিটে মেজাজ এবং মনোযোগের অভাব দেখা দিতে পারে। প্রথমে কফি পান করলে অস্বস্তি আরও বাড়তে পারে। আসল সমস্যাটি হলো পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন। পর্যাপ্ত পানি পানের পরেই শরীরের ভারসাম্য ফিরে আসে এবং সতেজ বোধ হয়।
প্রতিদিন কতটা পানি পান করা উচিত, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। অনেকেই নানা ধরনের পানির বোতল ব্যবহার করেন। কিন্তু যেটা প্রায়শই আলোচনা হয় না, তা হলো—শুধু কতটা পানি পান করা হচ্ছে সেটাই বড় কথা নয়, শরীর থেকে কতটা পানি বেরিয়ে যাচ্ছে, সেটাও সমান জরুরি।
রোগীরা, এমনকি যাদের কিডনিতে পাথরের সমস্যা নেই, তারাও ইউরোলজিস্টদের প্রায়শই জিজ্ঞাসা করেন, "আমার কতটা পানি পান করা উচিত?" এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন, কারণ এর কোনো নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। একজন ইউরোলজিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী, লক্ষ্য শুধু কত গ্লাস পানি পান করা হলো তা নয়, আসল লক্ষ্য হলো শরীর থেকে পর্যাপ্ত মূত্র তৈরি করা। একটি স্বাস্থ্যকর পানি পানের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য আরও কিছু বিষয় জেনে নেওয়া যাক।
পানি শরীরের জন্য কতটা জরুরি?
মানব শরীরের প্রায় ৬০% পানি। এই তরল কোষের ভেতরে, কোষের মধ্যে এবং রক্তপ্রবাহে থাকে। এটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও জয়েন্টগুলোকে সুরক্ষিত রাখে, প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও হরমোন বহন করে, শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয় এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
পানি সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্লোরাইডের মতো ইলেক্ট্রোলাইটের সাথে মিলে কাজ করে, যা মাংসপেশি সংকোচন, স্নায়ু সচল রাখা এবং রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া পানির তুলনায় পান করা পানির পরিমাণ কম হলে, ইলেক্ট্রোলাইটের ঘনত্ব বদলে যেতে পারে। এ কারণেই পানিশূন্যতার লক্ষণ হিসেবে মাংসপেশিতে টান, মাথা ঘোরা বা এমনকি অনিয়মিত হৃদস্পন্দন দেখা দিতে পারে।
যখন শরীর সামান্য পানিশূন্য হয়ে পড়ে, তখন ভারসাম্য বজায় রাখতে তাকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হয়। রক্ত ঘন হয়ে যায়, হৃদপিণ্ডকে আরও জোরে পাম্প করতে হয় এবং মস্তিষ্কের ওপর চাপ পড়ে—যার ফলে ক্লান্তি, অস্পষ্ট চিন্তাভাবনা এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি হয়। হজম প্রক্রিয়াও ধীর হয়ে যেতে পারে, কারণ পানি খাবারকে অন্ত্রের মধ্যে দিয়ে চলাচল করতে সাহায্য করে।
অন্যদিকে, পর্যাপ্ত সোডিয়াম ছাড়া অতিরিক্ত পানি পান করাও সমান বিপজ্জনক, বিশেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যায়াম করার সময়। এটি রক্তে সোডিয়ামের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, যার ফলে বিভ্রান্তি, বমি বমি ভাব এবং গুরুতর ক্ষেত্রে খিঁচুনিও হতে পারে। তাই শুধু পানি নয়, বরং পানি এবং ইলেক্ট্রোলাইটের সঠিক সমন্বয় দরকার।
ঠিক কতটা পানি প্রয়োজন?
দিনে আট থেকে দশ গ্লাস পানি পানের কথা শুনলে অনেকেই আঁতকে ওঠেন, কারণ তারা এর ধারেকাছেও থাকেন না। আসল কথা হলো, কিছু মানুষের বেশি পানির প্রয়োজন হয়, আবার কিছু মানুষের কম। শিফটে কাজ, ভ্রমণ বা অন্য ব্যস্ততার কারণে এটি আরও কঠিন হতে পারে।
ন্যাশনাল একাডেমি অফ মেডিসিনের মতে, সাধারণ পরামর্শ হলো—বেশিরভাগ পুরুষের জন্য দিনে প্রায় ৩.৭ লিটার এবং বেশিরভাগ মহিলাদের জন্য ২.৭ লিটার পানি প্রয়োজন। এটি শুধু পানীয় পানি থেকে নয়, বরং সমস্ত উৎস (খাবারসহ) থেকে। এর প্রায় ২০% সাধারণত খাবার থেকে আসে। এই সংখ্যাগুলোকে একটি প্রাথমিক ধারণা হিসেবে ধরা উচিত, কোনো কঠোর নিয়ম হিসেবে নয়।

মনে রাখতে হবে, কতটা মূত্র তৈরি হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ: ইউরোলজির নির্দেশিকা অনুসারে, কিডনিতে পাথর ফিরে আসা রোধ করতে দিনে অন্তত ২.৫ লিটার মূত্র তৈরি করা উচিত।
শরীরের আকার, কাজের পরিমাণ, জলবায়ু এবং ওষুধের ওপর পানির প্রয়োজনীয়তা নির্ভর করে। এর কোনো নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। এ কারণেই পরিমাণ গোনার চেয়ে সহজ 'মূত্রের রঙ পরীক্ষা' পদ্ধতিটি অনেক বেশি কার্যকর।
পানি পানের অবস্থা বোঝার একটি সহজ উপায়
মূত্রের দিকে নজর রাখা একটি কার্যকর পদ্ধতি। লক্ষ্য হবে সারাদিন ধরে হালকা হলুদ রঙের মূত্র। মাঝারি থেকে গাঢ় হলুদ রঙের অর্থ হলো, আরও পানি পান করা প্রয়োজন। ভিটামিন ও কিছু খাবার মূত্রের রঙ পরিবর্তন করতে পারে এবং সকালের প্রথম মূত্র প্রায় সবসময়ই গাঢ় হয়—এটা স্বাভাবিক।
কিছু কিছু দিনে বেশি পানির প্রয়োজন হয়: যেমন—যখন গরম বা আর্দ্রতা বেশি থাকে, দীর্ঘ সময় ধরে ব্যায়াম করার সময়, জ্বর হলে, বমি বা ডায়রিয়া হলে, উঁচু কোনো স্থানে ভ্রমণ করলে বা লবণাক্ত খাবার খেলে।
গরমের সময়, অল্প অল্প করে ক্রমাগত পানি পান করা সবচেয়ে ভালো—প্রায় প্রতি ১৫ থেকে ২০ মিনিটে ৮ আউন্স। এক ঘণ্টায় ৪৮ আউন্সের (প্রায় ১.৫ লিটার) বেশি পান করা উচিত নয়, নাহলে রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
মূত্রনালীর সংক্রমণ বা ইউটিআই প্রতিরোধে পানি পান করা পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্যই জরুরি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে মহিলারা প্রতিদিন প্রায় ১.৫ লিটার অতিরিক্ত পানি পান করেছেন, তাদের ইউটিআই -এর হার প্রায় ৫০% কমে গেছে এবং তাদের অ্যান্টিবায়োটিকও কম লেগেছে।
অতিরিক্ত পানি পান করাও বিপজ্জনক হতে পারে
অতিরিক্ত পানি পান করা—বিশেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যায়াম করার সময়—রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে কমিয়ে দিতে পারে, যা হাইপোনেট্রেমিয়া নামে পরিচিত। প্রায়শই দেখা যায়, ম্যারাথন দৌড়বিদরা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি পানি পান করার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। গরমে দীর্ঘ সময় দৌড়ালে পানির সাথে লবণও গ্রহণ করা উচিত—স্পোর্টস ড্রিঙ্কস বা লবণাক্ত খাবারের মাধ্যমে।
কিডনি রোগ বা হার্ট ফেইলিউরের মতো দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা থাকলে অতিরিক্ত সতর্ক থাকা উচিত। এসব ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত পানি পান করলে শরীরে ফোলাভাব, শ্বাসকষ্ট বা ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে। এই ব্যক্তিদের জন্য, তরল গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা সবসময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারণ করা উচিত।
কোন ধরনের পানি সবচেয়ে ভালো?
সাধারণ পানিই আদর্শ। যারা নিয়মিত কফি বা চা পান করেন, তাদের জন্য এগুলিও পানির উৎস হিসেবে গণ্য হয়। পরিমিত পরিমাণে কফি পানির মতোই জলয়োজনে সহায়ক। তবে অ্যালকোহল শরীর থেকে পানি বের করে দেয়।
দোকানে বিভিন্ন ধরনের পানি (অ্যালকালাইন, স্প্রিং ওয়াটার ইত্যাদি) পাওয়া যায়। এগুলো বেশিরভাগই বিপণনের চমক। কিডনির জন্য ব্র্যান্ডিংয়ের চেয়ে ধারাবাহিকতাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো বিশেষ ধরনের পানি কাউকে বেশি পান করতে উৎসাহিত করে, তবে তা ভালো। কিন্তু এর জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করার কোনো প্রয়োজন নেই।
সাধারণ পানির স্বাদ ভালো না লাগলে লেবু বা ফলের টুকরো যোগ করা যেতে পারে। সেরা পানি সেটাই, যা সারাদিন ধরে আসলেই পান করা হবে।
দীর্ঘ সময় ঘাম ঝরলে পানির পাশাপাশি সোডিয়াম পূরণের জন্য ইলেক্ট্রোলাইট বা লবণাক্ত খাবার প্রয়োজন। দৈনন্দিন জীবন এবং পরিমিত ব্যায়ামের জন্য, পানি এবং একটি সুষম খাদ্যই সাধারণত যথেষ্ট। পানির বোতলের ক্ষেত্রেও একই কথা: "সেরা" বোতল সেটাই, যা ব্যবহার করা হবে। অভ্যাসের চেয়ে পাত্রটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
পানি পানকে দৈনন্দিন রুটিনের একটি অংশ করে তোলা জরুরি। কাজের ফাঁকে পানি পানের জন্য বিরতি নেওয়া একটি ভালো অভ্যাস। উদাহরণস্বরূপ, একজন সার্জন অস্ত্রোপচারের মাঝে পানি পান করতে পারেন। যদি দিনে সাতটি অস্ত্রোপচার থাকে, তবে পানি পানের জন্য সাতটি সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। ক্লিনিকে রোগীদের ভিড়ে সুযোগ কম হলেও, দুপুরের খাবার বা বাড়ি ফেরার পথে সেই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।
জরুরি পরিস্থিতিতে, যেমন—ঘূর্ণিঝড় বা তাপপ্রবাহের সময়ই শুধু পানির কথা ভাবা উচিত নয়। বরং পানি পানকে একটি দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত করা দরকার।