বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে আটকে আছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ১৮৭ কোটি টাকা

একসময় এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেডে (বিসিবিএল) স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা ১৮৭ কোটি টাকা ফেরত পেতে হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক।
বিশেষায়িত ব্যাংক পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বারবার টাকা ফেরত দেওয়ার অনুরোধ সত্ত্বেও কমার্স ব্যাংক তা দিতে পারেনি। এর জেরে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
কমার্স ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের বড় অঙ্কের টাকা পাওনা থাকায় তারা এই মুহূর্তে বড় করপোরেট আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করতে পারছেন না।
কমার্স ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান মো. রফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা এই মুহূর্তে বড় অঙ্কের মূল টাকা ও করপোরেট আমানত নগদায়ন করতে পারছি না; এটাই বাস্তবতা।'
গত ২৮ আগস্ট কমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পাঠানো এক চিঠিতে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমা বানু বলেন, মেয়াদ পূর্ণ হওয়া আমানতের অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
চিঠিতে বলা হয়, 'আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ও ফোনে যোগাযোগ করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি, যা চরম অবহেলা এবং ব্যাংকিং শিষ্টাচার ও করপোরেট সংস্কৃতির পরিপন্থী।'
চিঠিতে আরও সতর্ক করা হয় যে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। চিঠির অনুলিপি অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছেও পাঠানো হয়েছে।
গতকাল রাত পর্যন্ত কমার্স ব্যাংক ওই অর্থ পরিশোধ করেনি এবং আইনি পদক্ষেপের বিষয়েও নতুন কোনো তথ্য জানা যায়নি।
পাওনার কথা বলছে কমার্স ব্যাংক, জবাব দেওয়ার আশ্বাস
রফিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, পাঁচটি ব্যাংক ও সাতটি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিসিবিএল ১ হাজার ৬১০ কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে।
তিনি বলেন, 'ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে এই বড় আমানতগুলো পরিশোধ করা হবে।' তিনি আরও বলেন, ব্যাংকটি বর্তমানে মেয়াদ সমন্বয়, মুনাফা প্রদান ও মূলধন নবায়নের মাধ্যমে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের আমানত পরিচালনা করছে।
তিনি আশ্বাস দেন, ব্যাংকটি শিগগিরই পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চিঠির আনুষ্ঠানিক জবাব দেবে।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এক ব্যাংকের পক্ষে অন্য ব্যাংকের আমানত ফেরত দিতে না পারা দেশের ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট ও করপোরেট সুশাসন নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, 'একটি ব্যাংক যদি বারবার অন্য প্রতিষ্ঠানের টাকা আটকে রাখে এবং জনসমক্ষে অর্থ পরিশোধে অক্ষমতার কথা স্বীকার করে, তবে তা এই খাতে অস্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়। এ ধরনের সংকট সমাধান করতে ব্যর্থ হলে তা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আস্থা নষ্ট করতে পারে।'
১৯৯২ সালে তারল্য সংকটের কারণে বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিসিবিএল গঠিত হয়। বর্তমানে সরকার ও কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের হাতে এর ৫১ শতাংশের মালিকানা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কমার্স ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বা ৫৪ শতাংশই খেলাপি। এছাড়া ব্যাংকটির ৪৪৪ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি ও ১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি ছিল।
গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট কমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়। কিন্তু নতুন পর্ষদ নিয়োগ দেওয়া সত্ত্বেও এর সুশাসন নিয়ে উদ্বেগ কাটেনি।
চলতি বছরের ৩১ জুলাই পরিচালক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন চাপের মুখে পদত্যাগ করেন। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে তাকে পুনর্বহালের সুপারিশ করা হলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেনি।