‘পদত্যাগ’ করা কমার্স ব্যাংকের এমডিকে ফেরাতে, চেয়ারম্যানের অপসারণ চায় বাংলাদেশ ব্যাংক
গত জুলাই মাসের শেষ থেকে চলতি আগস্টের শুরু পর্যন্ত— মাত্র ১০ দিনের মধ্যে তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদত্যাগ করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের এমডি মোশাররফ হোসেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকদের তদন্তে উঠে এসেছে, ৩০ জুলাই মোশাররফ হোসেন পদত্যাগ করার এক দিন আগে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান তাকে ডেকে বলেন, "আপনি আজকেই পদত্যাগ করে অফিস ত্যাগ করবেন।"
এমন নির্দেশনার পর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, "এখন লেট আওয়ার, আজকে পদত্যাগপত্র লেখা একটু কঠিন হবে স্যার। তবে আমি আপনার নির্দেশের বাইরে যাব না। আগামীকালই পদত্যাগপত্র জমা দেব।"
গত ৩০ জুলাই কমার্স ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করলে বিষয়টি ব্যাংকিং খাতে আলোড়ন তোলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেই প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে আসে।
দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়মে জড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। সরকার পরিবর্তনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আতাউর রহমানকে চেয়ারম্যান এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মহসিন মিয়াকে নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান করে পাঁচ সদস্যের নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়।
নতুন পর্ষদে শেখ আশ্বাফুজ্জামান এফসিএকে অডিট কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। বাকি দুই সদস্য পূর্ব থেকেই ছিলেন।
তবে ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড় করানোর জন্য পর্ষদ পুনর্গঠন করা হলেও— বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে, নতুন পর্ষদ দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করছে। বিশেষ করে চেয়ারম্যান ও নির্বাহী চেয়ারম্যান ঋণ কার্যক্রম, নিয়োগ, বদলি, শাস্তি—সবকিছুতেই হস্তক্ষেপ করছেন। তারা প্রায়ই কর্মকর্তাদের কক্ষে ডেকে অনিয়মতান্ত্রিক নির্দেশনা দিতেন। নির্দেশ অমান্য করলে অশালীন ভাষায় গালাগালও করতেন। কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশও দিতেন তারা। এসব হস্তক্ষেপ নিয়ে আপত্তি জানানো এমডিকে পদত্যাগে বাধ্য করার অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে।
ব্যাংক সূত্র জানায়, মোশাররফ হোসেন এবছরের ১৬ জানুয়ারি এমডি হিসেবে যোগ দেন এবং ৩০ জুলাই পদত্যাগ করেন। এই সময়ে তার মোট কর্মদিবস ছিল ১২৬ দিন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান ১১৩ দিন এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান ১০৮ দিন অফিস করেছেন।
আরেকটি বড় কারণ ছিল, সুরুজ মিয়া স্পিনিং মিলসের ৪৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফে এমডির আপত্তি। এই প্রতিষ্ঠানেই আগে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মহসিন মিয়া।
ব্যাংকটির কোম্পানি সচিব বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছেন, বোর্ড বিভিন্ন ইস্যুতে এমডিকে চাপ দিত, এমনকি কিছু কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে পর্ষদ মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার জন্যও এমডিকে চাপ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ব্যাংকের দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদেরকে পর্ষদ কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার সুপারিশ করা হয়।
একইসঙ্গে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ৪৬(২) ধারার ক্ষমতাবলে সাময়িক চেয়ারম্যান নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া ব্যাংকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একজন উপযুক্ত কর্মকর্তাকে মনোনীত করার প্রস্তাব করা হয়।
পর্ষদ-কর্তৃক এমডি মোশাররফ হোসেনের পদত্যাগপত্র অনুমোদন না করে তাঁকে দ্রুত কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশনা দেওয়ার কথাও সুপারিশে বলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংককে যা বলেছেন চেয়ারম্যান
কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান তাঁর লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন টিমকে জানান, ২৯ জুলাই ব্যাংকের আমানত, ঋণ, শ্রেণিকৃত ঋণের হারসহ বিভিন্ন সূচক নিয়ে আলোচনার সময়—এমডি নিজের ব্যর্থতার দায় নিয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানান এবং বোর্ড কক্ষ ত্যাগ করেন। পরদিন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
চেয়ারম্যান দাবি করেন, পর্ষদ কখনোই এমডিকে চাপ প্রয়োগ করেনি। বরং এমডির ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অদক্ষতা এবং সুরুজ মিয়া স্পিনিং মিলের সুদ মওকুফ প্রসঙ্গে ভুল তথ্য প্রদানের কারণে তিনি পদত্যাগ করেছেন।
ঋণের সুদ মওকুফে এমডির আপত্তি
গত ২৯ জুলাই পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে সুরুজ মিয়া স্পিনিং মিলের ৮৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৪৮ কোটি টাকার সুদ মওকুফে এমডি আপত্তি জানান। এতে চেয়ারম্যান ক্ষিপ্ত হন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন টিম দ্বারা অডিও যাচাইয়ে দেখা গেছে, গ্রাহক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে চেয়ারম্যানের সরাসরি যোগাযোগ এবং আঞ্চলিক প্রধানদের সঙ্গে দৈনন্দিন কাজের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেন এমডি। নতুন নিয়োগ নিয়েও তিনি অনীহা প্রকাশ করেন।
সেই বৈঠকে পরিচালক গোলাম মরতুজা বলেন, সরাসরি পদত্যাগ করালে গভর্নরের কাছে অভিযোগ হতে পারে, তাই অভিযোগ দাঁড় করানো দরকার। তবে পর্ষদে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি কামরুল হক মারুফ প্রস্তাব দেন, এমডিকে অন্তত এক-দুই মাস সময় দেওয়া উচিত। কিন্তু, শেষপর্যন্ত চেয়ারম্যান আতাউর রহমান এমডিকে নির্দেশ দেন, "আজকেই পদত্যাগ করে অফিস ছাড়বেন।" এমডি পরদিন পদত্যাগপত্র জমা দেন।
পদচ্যুত এমডি মোশাররফ টিবিএসকে যা বলেছেন
পদত্যাগকারী এমডি মোশাররফ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করছে। আমাকে নানা বিষয়ে চাপ দেওয়া হতো। পর্ষদ পদত্যাগ করতে বলেছিল, তাই আমি পদত্যাগ করেছি। চেয়ারম্যানের নির্দেশনা শুনতে হয়, তবে এমডি হিসেবে আমারও কিছু কথা বলার অধিকার আছে। তিনি সেটি মানেননি। আগামী রোববার আমাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডেকেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমি কাজ করব।"
এবিষয়ে মন্তব্যের জন্য ফোনে যোগাযোগ করা হলে চেয়ারম্যান আতাউর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
