পারফিউম ব্র্যান্ড আরএসআর: দেশের বাজারে পরীক্ষা শেষে যাবে বিশ্ববাজারে
দেশে সুগন্ধি-বাজারের বেশিরভাগই আতরের দখলে। তবে পারফিউমের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কারণ তথ্য সহজলভ্য হচ্ছে, পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে, বেড়েছে ক্রয়ক্ষমতাও। অথচ দেশি কোনো পারফিউম ব্র্যান্ড নেই। বিছিন্নভাবে দু-একবার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। এই যখন অবস্থা, তখন আরএসআরের যাত্রা হলো শুরু।
জমিদারি আমলেও পারফিউম ব্যবহারের চল ছিল বঙ্গভূমে, তা নিঃসন্দেহ হয়েছেন রায়হান সুলতান বেচারাম দেউড়ির আবুল খায়রাতের জমিদারবাড়িতে গিয়ে। তাই এখানে পারফিউমের ব্যবহার যে অল্পদিনের, তা বলা যায় না; তবে সীমিত থেকেছে ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে, তা বলা যায়। এখন ইন্টারনেটের আমলে তরুণদের মধ্যে পারফিউম নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে কয়েকগুণ। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় দলবেঁধে পারফিউমের গুণাগুণ, উপকরণ, মূল্য ইত্যাদি নিয়ে আলাপ-সালাপ করে।
রায়হান সুলতান পেশায় একজন সিনিয়র ব্যাংকার। পারফিউম ও সংগীতে তার গভীর অনুরাগ। পারফিউমোলজিবিডি নামের ফেসবুক গ্রুপ ও পেইজের তিনি প্রতিষ্ঠাতা ও অ্যাডমিন। একই নামে তার ইউটিউব চ্যানেলও আছে। তিনি পারফিউম রিভিউ করে তার সাবস্ক্রাইবারদের জানান কোন পারফিউমটি কেমন।
রিভিউয়ার হওয়ার কারণে রায়হান সুলতানের সঙ্গে অনেক পারফিউমপ্রেমীর যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, দেশে আর্টিসানাল (অভিজ্ঞ পারফিউমারের তৈরি) বা ডিজাইনার (নির্দিষ্টসংখ্যক) পারফিউমের চাহিদাও বাড়ছে, কিন্তু দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন কোনো পারফিউম ব্র্যান্ড নেই।
সব পারফিউম সব আবহাওয়ায় উপযোগী নয়। তাই আমাদেরও দরকার আমাদের আবহাওয়ার উপযোগী পারফিউম। ২০২২ সালে তিনি ভাবতে থাকেন আমাদের দেশি থিমের পারফিউম তৈরি করার কথা, এজন্য প্রয়োজন দেশি একটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করা। সঙ্গী হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান সাইফুল আজম চৌধুরী সাইফি এবং রাশেদ চৌধুরীকে। তারা সম্মত হলে তিনজনের আদ্যাক্ষর মিলিয়ে ব্র্যান্ডের নাম হলো আরএসআর। এদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী পারফিউম বিশেষজ্ঞ, পারফিউমাররাও তাকে দিয়ে পারফিউম টেস্ট করিয়ে নেন, থাকেন দুবাইয়ে।
কর্ণফুলীর নামে নাম
আরএসআরের তিনজনেরই বাড়ি চট্টগ্রামে। কর্ণফুলী নদীটি চট্টগ্রামের প্রাণভোমরা। তারা স্থির করলেন, প্রথম পারফিউমটির থিম হবে কর্ণফুলী, নামও ভিন্ন হবে না। নদীটির দুই পারে অনেক কার্যক্রম যেমন মশলা পরিবহন, মাছের কারবার, বুনো ফুলের বাহার, শুটকি বেঁচা-কেনা, কাঠের ব্যবসা, নৌকায় আলকাতরা লেপন ইত্যাদি। তারা চাইলেন এগুলোর সমাবেশ ঘটাতে পারফিউটিতে। স্বনামধন্য পারফিউমার জাকির গফুরের সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল রাশেদ চৌধুরীর। গফুরের কর্মস্থল দুবাই, জন্মস্থান ভারতের আসাম। মেঘালয়ের লুসাই পাহাড়ে কর্ণফুলীর জন্ম, আগে লুসাই পাহাড় আসামেরই অংশ ছিল। সে অর্থে কর্নফুলী নদী গফুরের অচেনা নয়। বাকীটা টেলিফোনে রায়হান, সরাসরি রাশেদ তাকে বুঝতে সাহায্য করেছেন। গফুরকে কর্নফুলীর দায়িত্ব দেওয়ার পিছনে আরো একটি কারণ ছিল- তিনি উডি (কাঠগন্ধী) নোটে যশস্বী। পারফিউমটির তৈরি পর্বে দশবার নিরীক্ষা বা দশটি কম্বিনেশন তৈরি করেছিলেন গফুর। সেগুলোর প্রত্যেকটি বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছিল আরএসআর। শেষবারে সবাই যখন সহমত হয়েছিল তখন ১০০ পিস কর্ণফুলী তৈরি করিয়ে আনা হয় যার প্রতিটি বোতলের (৫০ এমএল) দাম ধরা হয়েছিল ৭ হাজার ৮০০ টাকা। গেল কোরবানির ঈদের দিন কর্ণফুলীর মোড়ক উন্মোচন করা হয় আর তার তিনদিনের মাথায় সবগুলো পারফিউম বিক্রি হয়ে যায়। রায়হান বললেন, 'এটি ছিল আমাদের পাইলট প্রজেক্ট। যারা ব্যতিক্রমী কিছুতে আগ্রহী মানে যাদের ম্যাচিওরড নোজ, তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে কর্ণফুলী। পুরো প্রকল্পে আমাদের ৭ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল।'
দু মাস পরেই আরএসআর বাজারে আনে 'আন্ডার দ্য সান' নামের আরেকটি পারফিউম। বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী (গরম, ধোঁয়া, ধুলা, ট্রাফিক জ্যাম, ঘাম ইত্যাদির সঙ্গে লড়তে সক্ষম) পারফিউম এটি। এর পারফিউমার ছিলেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত দুবাই প্রবাসি আবু হাসির। তিনি গরম সম্পর্কে অবহিত কিন্তু ঘাম, ট্রাফিক জ্যাম তার চেনা নয়। রাশেদ চৌধুরী এক্ষেত্রে সেতু হিসেবে কাজ করেছেন। পারফিউমোলজি বিডিতে 'আন্ডার দ্য সান' এর আগমন বার্তা ঘোষিত হওয়ার পরপরই ৫০ ভাগের আগাম বুকিং (সংরক্ষণ) পাওয়া যায়। আন্ডার দ্য সানের প্রতিটির দাম ছিল ৭০০০ টাকা। রায়হান বললেন, ' প্রাকৃতিক উপকরণ এবং অভিজ্ঞ পারফিউমার দিয়ে আমরা পারফিউম তৈরি করিয়ে নিই বলে এগুলোর দাম বেশি হয়। আগামীতে আরো ১০টি পারফিউম রিলিজ দেওয়ার পরে ঠিক করব বাণিজ্যিকভাবে বিনিয়োগ করব কিনা। এর মধ্যে বোঝার চেষ্টা করব কোন পারফিউমটি ইউরোপের বাজারের জন্য উপযোগী, কোনটি মধ্যপ্রাচ্যের। মধ্যপ্রাচ্যের বাজার ইউরোপের চেয়ে বড়। আমাদের লক্ষ্য বিশ্ববাজার।'
ক্লিওপেট্রার পারফিউম
পারফিউমের ক্লিওপেট্রা নাকি ক্লিওপেট্রার পারফিউম? উত্তর হবে, দুজনে দুজনার। একটি ঘটনা বয়ান করলে ওই উত্তরের প্রমাণ মিলবে।
ক্লিওপেট্রার দরকার ছিল অ্যান্টনিকে হাতে রাখা। এতে একদিকে তখত বাঁচে অন্যদিকে সাম্রাজ্যও বড় করে তোলা যাবে। রূপে অনন্যা ক্লিওপেট্রা মিসরের রানী, সুগন্ধির এক বিশাল ভান্ডার ছিল তার। গায়ে, পোশাকে, ঘরে এমনকি জাহাজের পালেও তিনি সুগন্ধি ছড়িয়ে দিতেন। রোমান জেনারেল অ্যান্টনিকে হাত করতে চেয়ে ক্লিওপেট্রা চড়লেন জাহাজে। আলেকজান্দ্রিয়ার উপকূলে তার জাহাজ ভিড়বার আগেই অ্যান্টনি সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে গেলেন, প্রথম চালেই জিতে গেলেন ক্লিওপেট্রা।
সুগন্ধি হবে তো এমনই হবে। দীর্ঘক্ষণ জড়িয়ে থাকবে, দূর থেকে লোকে টের পাবে, অন্যকে আমোদিত করবে, নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করবে। রায়হান সুলতান বললেন, ' পোশাকের মতো পারফিউমও পরার জিনিস। ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার কোকো শানেল বলে গেছেন, আমাদের সাজ-সজ্জা সম্পূর্ণ হয় না যতক্ষণ আমরা পারফিউম না পরি। এজন্য পারফিউম লাভারদের বলতে শুনবেন আজকে খুব গরম পড়েছে তাই অমুক পারফিউম ওয়্যার (পরিধান) করেছি।'
পারফিউমোলজি বিডি
পারফিউমোলজিবিডির সদস্য সংখ্যা ১০ হাজার। নিয়মিত তারা সুগন্ধি নিয়ে আলাপ-আলোচনায় মাতোয়ারা হন গ্রুপটিতে। যেমন এর টপ কনট্রিবিউটরদের একজন দিলারা খান মালয়েশিয়াতে গিয়ে জানতে চাইছেন, 'এখান থেকে কোনো পারফিউম কেনা যায়?'
রায়হান সুলতান উত্তর দিচ্ছেন, 'মালয়েশিয়া থেকে পারফিউম না কেনাই ভালো, অনেক দাম।' আরেকজন টপ কন্ট্রিবিউটর আদনান হক লিখছেন, 'না মালয়েশিয়া থেকে পারফিউম কিনবেন না। নকলটা ধরিয়ে দিতে পারে।' দিলারা খান আবার জানতে চাইছেন, 'এখানে বিঅ্যান্ডবির অথরাইজড (অনুমোদিত) আউটলেট আছে, সেক্ষেত্রে কি ভরসা করা যায়?' আদনান হক উত্তর দিচ্ছেন, 'দাম কিন্তু অনেক বেশি আপু।'
জবাব পেয়ে গেছেন দিলারা খান, তাই আলাপের পরিসমাপ্তি ঘটল। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে পাই আরমান মুরসালিন আমিনের একটি পোস্ট। তিনি কেলভিন ক্লেইনের 'বি' নামের পারফিউমটি নিয়ে আলোচনা করছেন যেটি ১৯৯৬ সালে বাজারে আসে। সুইস পারফিউমার রেনে মরগেনথালের এর উদ্ভাবক। এর টপ নোট হচ্ছে লাভেন্ডার, লেবু জাতীয় ফল বার্গামোট, পুদিনা, জুনিপার এবং মান্দারিন কমলালেবু। মধ্য বা মিডল নোট হলো সবুজ ঘাস, জেসমিন, পিচ, ম্যাগনোলিয়া ও অর্কিড এবং বেইজ নোট হলো মৃগনাভি, চন্দনকাঠ, চেডার, ভ্যানিলা, অ্যাম্বার ইত্যাদি।
পরে সুপ্রিয় সাহা অর্কর একটি পোস্ট দেখলাম যেখানে তিনি জানতে চাইছেন, নিজের উপার্জনের প্রথম পারফিউম কোনটি? এর জবাব যা পাওয়া গেল তাতে বেশ কিছু পারফিউমের নাম জানা হয়ে গেল যেমন গুচ্চি ব্লুম, আরমানি কোড, প্লেবয় নিউ ইয়র্ক, হুগো বস ডার্ক ব্লু, নটিকা বয়েজ ব্লু, ডলচে অ্যান্ড গ্যাবানা পোর হোম, পাকো রাবান ফ্যান্টম, আফনান নাইন পিএম, ক্রিস্টিয়ান ডিওর সুভাস।
গ্রুপটি ঘুরে আরো যেসব নাম জানা গেল সেগুলো হলো ডানহিল, প্রাডা, লেকোস্ট, লুই ভুইটন, গিভেঞ্চি, রালফ লরেন, আরমেস, বুলগারি, আমুজ, জারজোফ ইত্যাদি। আমাদের দেশে বেশি পরিচিত ওয়াইল্ড স্টোন, ফগ, সিকে, হুগো বস বা ডানহিল। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সুবাসের সুগন্ধি আছে যেমন ফুলের, ফলের, চামড়ার, কাঠের, প্রাণীর, আইসক্রিমের, কফির বা মশলার। আধুনিক কালের কোনো পারফিউমই একক সুবাসের হয় না।
রায়হান সুলতানের ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, 'পারফিউমের মূল উপকরণ হলো অয়েল বা তেল। দুই থেকে ৪০ ভাগ পর্যন্ত অয়েল ব্যবহৃত হয় পারফিউমে যার মধ্যে চামড়ার, ফুলের, মিষ্টি উপকরণের বা বাদামের নির্যাস থাকে। টপ নোট বা বেজ নোট তৈরি হয় এই নির্যাস দিয়েই। আগের দিনের রাজা বা নবাবদের নিজস্ব পারফিউমার থাকত। তারা রাজার জন্য হামানদিস্তায় বিভিন্ন উপকরণ গুড়ো করত বা বৃহৎ পাত্রে সিদ্ধ করত অথবা আগুনে পুড়িয়ে বাস্প ভরে নিতেন শিশিতে। এরপর গন্ধ শুকতে থাকতেন আর অনুপাত বদলে দিতেন যতক্ষণ না কাঙিক্ষত সুবাস বেড়িয়ে আসত। তারপর তা তুলে দিতেন রাজার হাতে। খুশি হয়ে রাজা নিজের গলার হার পারফিউমারের গলায় পরিয়ে দিতেন।'
আরমানি গিয়েছিলেন সাগরপারে
পারফিউমের রেসিপি যিনি তৈরি করেন তিনি পারফিউমার। সাধারণত পারফিউম ব্র্যান্ডগুলো সেসব রেসিপি কিনে নিয়ে নিজেদের নামধাম ছাপিয়ে মোড়কবন্দি করে বাজারজাত করে।
অনেক অভিজ্ঞ ক্রেতা পারফিউম কেনার আগে পারফিউমারের নাম দেখে নেন। তেমন পারফিউমারের মধ্যে আছেন ডমিনিক রপিয়ন, আলবার্তো মরিয়াস, জ্যাক কেভালিয়ার, গারলাইন প্রমুখ। এদের মধ্যে আলবার্তো মরিয়াঁসের একটি ঘটনা শোনালেন রায়হান, 'জর্জিও আরমানি ছুটি কাটাতে গেছেন এক সমুদ্রতীরে। হঠাৎ এক দমকা হাওয়া তার চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দিল। হাওয়ায় ভাসছিল লোনা পানির গন্ধ। আরমানি সঙ্গে সঙ্গে বার্তা পাঠালেন মরিয়াসের কাছে, "প্রস্তুত হও বন্ধু। আমি জেট পাঠাচ্ছি।" মরিয়াস বিলম্ব করেননি, জেটে চড়ে চলে এলেন সাগরপারে। আরমানি তাকে হাওয়ায় প্রাণভরে শ্বাস নিতে বললেন। মতলবটা ধরে ফেলতে মরিয়াসের বেশি সময় লাগল না। বললেন, এমন একটি পারফিউম চাই তো? হয়ে যাবে, চলো এবার মালসামানা নিয়ে বসি।'
'ঘটনাটি পারফিউম জগতে এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল। বদলে গিয়েছিল সেই চিরসত্য—পানির বর্ণ নেই, গন্ধ নেই। মরিয়াস পানির সুগন্ধি তৈরি করলেন আরমানির জন্য, যার নাম অ্যাকুয়া ডি জিও। পৃথিবীর প্রায় সব বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড এখন আকুয়া-বেজড পারফিউম তৈরি করে তবে এখনো পারফিউমপ্রেমী পুরুষদের প্রায় ৮০ ভাগের প্রথম পছন্দ অ্যাকুয়া ডি জিও।'
রায়হানের কাছে জানতে চাইলাম, পারফিউমের কি নারী-পুরুষ ভেদ হয়? তিনি বললেন, 'এটা মূলতই মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। সত্তরের দশকে যে পারফিউমগুলো নারীদের পছন্দের ছিল সেগুলো এখন পুরুষরা বেশি ব্যবহার করছেন। আবার উল্টো ঘটনাও আছে। কাজেই নারী-পুরুষ ভেদাভেদের আসলে কোনো ভিত্তি নেই। তবে রাত-দিন, মিটিং-পার্টি, স্টুডেন্ট-অফিস ওয়ার্কার ইত্যাদি ভেদে পারফিউম ভিন্ন হলে ভালো কাজ দেয়। গ্রীষ্ম-বর্ষা ভেদেও পারফিউম আলাদা হতে পারে। প্রখর গরমের দিনে ঝাঁঝালো পারফিউম গরম আরো বাড়িয়ে দেবে; সেক্ষেত্রে স্নিগ্ধ, সতেজ কোনো সুগন্ধি ব্যবহার করা যেতে পারে।'
কনভারসেশন স্টার্টার
এবার জেনে নেওয়া যাক পারফিউমের কাজ কি? মূলত কাজ তিনটি: ব্যাড স্মেল দূর করা, আত্মবিশ্বাস তৈরি করা ও আমোদিত করার মাধ্যমে অন্যকে সম্মান জানানো। কাজগুলো তখনই ফলদায়ক হয় যখন ঠিক সময় ও স্থানে ঠিক পারফিউমটি ব্যবহার করা হয়। যেমন দিনের বেলায় লেদার পারফিউম ব্যবহার সম্মান জানানোর পরিবর্তে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। পার্টিতে অনেকের সমাগম ঘটে, কথাবার্তা বিনিময় হয়, তাই মিষ্টি-মধুর পারফিউম ব্যবহার করাটা ভালো ফল আনবে। স্টুডেন্টরা অল্প জায়গায় অধিক সমাবেশ ঘটায় তাই তারা মিষ্টি ও ফ্রেশ পারফিউম ব্যবহার করলে ভালো হয়। পারফিউম অনেক ক্ষেত্রেই অবস্থান বা পদবীর পরিচয় প্রদান করে। বিশেষ করে অফিস বসের একটি সিগনেচার পারফিউম থাকলে মন্দ হয় না যা তার অধীনস্থ কর্মীদের উচ্ছসিত করে, প্রশংসা করতে উদ্দীপ্ত করে। পারফিউমকে বলা হয় কনভারসেশন স্টার্টার মানে যখন কোনো কথা খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন পারফিউমের ভালো-মন্দ দিয়েই কথা শুরু করা যায়।
আধুনিক পারফিউমের আঁতুড়ঘর
সুগন্ধির ইতিহাস সুপ্রাচীন। মিসরের ফারাও থেকে রোমান সম্রাট হয়ে বাদশা আকবর পর্যন্ত কে সুগন্ধির ভক্ত ছিলেন না! তবে রায়হান আধুনিক পারফিউমের আঁতুড়ঘর বিবেচনা করেন ফরাসি ফ্যাশন হাউজ গারলাইনকে। প্যারিসে ১৮২৮ সালে পারফিউমার পিয়েরে-ফ্রাঁসোয়া প্যাসকাল গারলাইন এটি প্রতিষ্ঠা করেন। গারলাইনার কাছে সাফল্য ধরা দেয় ১৮৫৩ সালে। সে বছর সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন এবং তার রানী ইউজিনের জন্য গারলাইন একটি পারফিউম তৈরি করে দিয়েছিলেন যেটি তাকে সম্রাটের দরবারি পারফিউমারের মর্যাদা এনে দিয়েছিল। তারপর তিনি যুক্তরাজ্যের রানি ভিক্টোরিয়া এবং স্পেনের রানি ইসাবেলার জন্যও সুগন্ধি তৈরি করেন। ১৮৬৪ সালে গারলাইন মারা গেলে উত্তরাধিকার হস্তান্তরিত হয় তার দুই সন্তান এমি এবং গ্যাব্রিয়েলের কাছে। এদের মধ্যে এমি ছিলেন একজন মাস্টার পারফিউমার। পরের প্রজন্মে এমির ভাতিজা, মানে গ্যাব্রিয়েলের ছেলে জ্যাক হয়ে উঠেছিলেন আরেকজন মাস্টার পারফিউমার। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে গারলাইন পরিবার দারুণ সব পারফিউম পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে মিৎসুওকো, শালিমার, ভার্টিভার ইত্যাদি। শালিমার নামের পারফিউমটি গারলাইন বাজারে এনেছিল ১৯২৫ সালে। লাহোরে সম্রাট শাহজাহান ১৬৪১ সালে বাগানটির নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন। বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর সব সুগন্ধির সমারোহ ঘটেছিল বাগানটিতে। গারলাইন বাগানটির প্রতি সম্মান রেখে এ নামকরণ করেছিল।
রায়হানের পারফিউম জগত
রায়হান পারফিউমের জগতে ঢুকে পড়েছিলেন শৈশবে। চট্টগ্রামে তাদের বাড়ির পিছনে ছিল ছোট্ট এক পাহাড়। খেলতে খেলতে পাহাড়ে উঠে পড়ত সে। সেখানকার বুনো ফুল, ফলের গন্ধ নিত। তার মায়েরও ছিল পারফিউমের শখ, এতটাই যে পারফিউম বিক্রেতারা নতুন কোনো পারফিউম এলে খবর পাঠাতেন। মায়ের পারফিউমের গন্ধে মাতোয়ারা হতো রায়হান। ভাবত, ঘ্রাণ এত সুন্দর হয়! আরেকটু বড় হলে বড় ভাইয়ের পারফিউমে ভাগ বসাত। স্কুলের সহপাঠীরা প্রশংসা করত, রায়হান তাতে আরো বেশি করে পারফিউমে আকৃষ্ট হয়। সেই যে ঘ্রাণ তাকে জড়িয়ে ধরল, আজও তা ছেড়ে যায়নি। রায়হানের কাছে প্রায় দেড় হাজার পারফিউম আছে, বৈচিত্র্যগুণে যা অনন্য।
পারফিউমোলজিবিডি নামে রায়হানের একটি ইউটিউব চ্যানেলও আছে, যেখানে সাড়ে ছয়শ ভিডিওচিত্র রয়েছে। এতে তিনি বিভিন্ন পারফিউমের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করেন এবং পারফিউম সম্পর্কে ধারণা দেন, যেন গ্রাহকরা তাদের সাধ্যানুযায়ী সঠিক ও উপযোগী পারফিউমটি খুঁজে পান। যারা পারফিউম ভক্ত নন তারাও অনেকরকম তথ্য পাবেন ভিডিওগুলো দেখে। এটি এক মজার জগৎ, যা হাতের কাছে কিন্তু জানার বাইরে বহুদিন ধরে। এবার সুযোগ এল সে জগতের বাসিন্দা হওয়ার, দিনরাত সুবাসিত থাকার।
