অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা, চাহিদা হ্রাস ও আর্থিক চাপ: সিমেন্ট কারখানাগুলো ৩০% সক্ষমতায় চলছে
বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্প ইতিহাসের অন্যতম কঠিন সময় পার করছে। অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা, ক্রমবর্ধমান আর্থিক ব্যয় ও চাহিদা কমে যাওয়া—এই তিন সংকটে খাতটির উৎপাদনকারীরা ব্যাপক চাপে পড়েছেন।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, এ শিল্পের বেশিরভাগ কারখানা ৩০ শতাংশেরও কম উৎপাদন ক্ষমতায় চলছে, যা বৈশ্বিক মানদণ্ড (৭০-৮০ শতাংশ) থেকে অনেক কম। ফলে বাজার অবিক্রীত সিমেন্টে সয়লাব হয়ে গেছে, দাম কমে যাচ্ছে এবং উৎপাদনকারীদের আর্থিক সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।
গত দশকে মেগাপ্রকল্প, আবাসন খাতের সুসময় ও ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনাকে ঘিরে আশাবাদী হয়ে বিনিয়োগকারীরা এ খাতে ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন। ফলে বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১০ কোটি টনে পৌঁছেছে, যা এক দশক আগের তুলনায় চারগুণ বেশি।
কিন্তু সেই তুলনায় তাল মিলিয়ে বাড়েনি চাহিদা। ২০২৪ সালে দেশে সিমেন্টের মোট চাহিদা ছিল মাত্র ৩.৮ কোটি টন, যা মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৪০ শতাংশেরও কম। চলতি বছর এ চাহিদা আরও কমে যাওয়ায় কারখানাগুলোকে উৎপাদন হ্রাস ও কর্মী ছাঁটাই করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি আমিরুল হক বলেন, 'করোনার পর ২০২১ সালে নির্মাণকাজ ফের শুরু হওয়ায় আমরা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ২০২৩ সাল থেকে পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'উদ্যোক্তারা মূলত সরকারি চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছিলেন। কিন্তু প্রকল্পের গতি কমে যাওয়ায় আমরা তীব্র নগদ প্রবাহের সংকটে পড়েছি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ছোট কারখানা বন্ধও হয়ে গেছে।'
'টিকে থাকার পর্যায়ের চেয়েও কমে চলছে কারখানা'
বছরে ৭৩ লাখ টন উৎপাদন ক্ষমতার বসুন্ধরা সিমেন্ট এখন মাত্র ২০ শতাংশ সক্ষমতা ব্যবহার করে পরিচালিত হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম জাহিদ উদ্দিন বলেন, 'আমরা জনবল কমিয়েছি, দামও অনেক কমিয়েছি, তারপরেও ক্রমাগত লোকসান গুনতে হচ্ছে।'
২০২৩ সালে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ১৮ লাখ টন করে মীর সিমেন্ট। সেই বিনিয়োগ এখন প্রতিষ্ঠানটির জন্য বোঝায় পরিণত হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিক্রি এতটাই কমে গেছে যে মোট সক্ষমতার মাত্র এক-চতুর্থাংশ উৎপাদন চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতেই আমরা হিমশিম খাচ্ছি। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধও হয়ে যেতে পারে।'
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলেন, বেঙ্গল সিমেন্ট, আরামিট সিমেন্ট ও মোস্তফা হাকিম সিমেন্ট ইতিমধ্যে তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
শীর্ষ উৎপাদকদের পরিস্থিতি
আবুল খায়ের গ্রুপের প্রতিষ্ঠান শাহ সিমেন্ট বার্ষিক ১ কোটি টন উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে দেশের বৃহত্তম উৎপাদক। প্রতিষ্ঠানটি তাদের কারখানার ৫০ শতাংশের বেশি সচল রেখেছে—যা অন্য অনেকের চেয়ে ভালো—তবে তারাও দাম ও চাহিদা নিয়ে অব্যাহত চাপে রয়েছে।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, 'আমরা কর্ণফুলী টানেলসহ অন্যান্য বড় প্রকল্পে সিমেন্ট সরবরাহ করেছি। কিন্তু এখন নির্মাণকাজের গতি কমে যাওয়ায় মাত্র ৪০ শতাংশ সক্ষমতায় কারখানা সচল রেখেছি।'
ক্রাউন সিমেন্টের উপদেষ্টা মাসুদ খান বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধীরগতির কারণে চাহিদা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে। 'দুই বছর ধরে অর্থনীতিতে গতিমন্থরতা চলছে। আমাদের উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ৬০ শতাংশই অব্যবহৃত থাকছে।'
ফ্রেশ ও মেঘনাসেম ডিলাক্স ব্র্যান্ডের সিমেন্ট উৎপাদনকারী মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই) এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম। প্রতিষ্ঠানটি ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে; তবে তাদের সক্ষমতার মাত্র ৬৫ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে।
গ্রুপটির নির্বাহী পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের নির্মাণকাজ অনেক কমে গেছে। বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক বেশি, আবার চাহিদাও ক্রমাগত কমছে।
তিনি বলেন, এই চাহিদা সংকট সামাল দিতে বিশেষ করে ছোট কোম্পানিগুলো বেশি হিমশিম খাচ্ছে।
কমছে দাম, বাড়ছে খরচ
শিল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ৫০ কেজির এক বস্তা সিমেন্ট এখন ৪৭০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক বছর আগের তুলনায় বস্তাপ্রতি প্রায় ২৫-৩০ টাকা কম।
অন্যদিকে ক্লিঙ্কার ও জিপসামের মতো আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম বেড়েছে। একইসাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকঋণের খরচও বেড়ে গেছে অনেক।
বিসিএমএ নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মেট্রোসেম সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, 'এই খাতে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, যার প্রায় ৭০ শতাংশই এসেছে ব্যাংকঋণ থেকে।'
তিনি আরও বলেন, 'আয় কমছে, কিন্তু ঋণের কিস্তি এবং সুদের ব্যয় বেড়েই চলেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য এই চাপ অসহনীয় হয়ে পড়েছে।'
মো. শহীদুল্লাহ বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান সরবরাহকারীদের পাওনা বা কর্মীদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না। এই শিল্পে সরাসরি প্রায় ৭-৮ লাখ ও পরোক্ষভাবে আরও ২ লাখ লোকের কর্মসংস্থান জড়িত। কারখানাগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় বা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান এখন ঝুঁকিতে।
সরকারের হস্তক্ষেপের আহ্বান
এই খাতের নেতারা থমকে থাকা সরকারি প্রকল্পগুলো ফের চালু করা, কাঁচামাল আমদানির প্রক্রিয়া সহজ করা এবং সংকটে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বিসিএমএ সভাপতি আমিরুল হক বলেন, 'প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন আবার শুরু হলে এবং ঋণপ্রাপ্তি সহজ হলে এই খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। নইলে আরও কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ঋণখেলাপি হওয়ার ঘটনা অনিবার্য।'
তবে তিনি এ-ও বলেন, 'বাংলাদেশে নাগরিক আবাসন ও অবকাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা বেশ শক্তিশালী। কিন্তু যতক্ষণ না এই চাহিদা বাড়ছে এবং আর্থিক চাপ কমছে, ততদিন পর্যন্ত সিমেন্ট শিল্পকে ইতিহাসের অন্যতম কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই যেতে হবে।'
