মার্কিন শুল্ক, নির্বাচন ব্যয় ও ব্যাংকখাত সংকটে ঝুঁকিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার: এডিবি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক বছর ধরে গতিমন্থরতা চলেছে, এরপরে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এসে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নতুন মার্কিন শুল্ক, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, উচ্চ নির্বাচনকালীন ব্যয়, সংকটগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে দেওয়া তারল্য সহায়তা এবং ব্যাংকখাতের অব্যাহত দুর্বলতার কারণে ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
আজ মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) – এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) প্রতিবেদনে এসব উদ্বেগ তুলে ধরা হয়েছে।
একইসঙ্গে এডিবি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কিছুটা কমালেও — প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হবে বলে ধারণা করছে, যা গত এপ্রিলের ৫.১ শতাংশ অনুমানের চেয়ে সামান্য কম। এরপরও এটি গত তিন বছরের মধ্যে দ্রুততম প্রবৃদ্ধি হবে। এর আগে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জন্য মাত্র ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করেছিল এডিবি।
এডিবি সতর্ক করে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক এবং সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা রপ্তানির প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। একই সঙ্গে ব্যবস্থাপিত ভাসমান বিনিময় হার নীতির দুর্বল বাস্তবায়ন বহিঃখাতের ভারসাম্যহীনতা আরও বাড়াতে পারে।
বাংলাদেশে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইউং জং বলেন, "ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি নির্ভর করবে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বাড়ানো ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার উপর।"
মুদ্রাস্ফীতি কমলেও ঝুঁকি রয়ে গেছে
এডিবি তাদের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে গড় মুদ্রাস্ফীতি চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৮ শতাংশে নামবে, যার এর আগের বছরের প্রায় ১০ শতাংশের থেকে কম। তবে এ উন্নতি আংশিক স্বস্তিই দিতে পারবে।
তবে ম্যানিলা-ভিত্তিক এ ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সতর্ক করেছে, "সাম্প্রতিক সময়ের কঠোর মুদ্রানীতি সত্ত্বেও, উচ্চ নির্বাচনকালীন ব্যয় এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা — মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে চাপ বাড়াতে পারে এবং গভর্ন্যান্সের সংস্কার দুর্বল করতে পারে।"
প্রতিবেদন আরও বলা হয়, "২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচন এবং আর্থিক খাতে চলমান সংস্কারের কারণে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়তে পারে।"
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন শুল্ক কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের গড় শুল্কহার ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫ শতাংশে পৌঁছাবে। পোশাক খাতে শুল্ক ১৬.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৩৬.৮ শতাংশে, আর কিছু পণ্যে—যেমন কৃত্রিম ফাইবার সোয়েটার—শুল্ক হবে ৫২ শতাংশ। এর প্রভাব পড়বে বিশেষ করে, পোশাকখাতে কর্মসংস্থান হওয়া বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের ওপর।
যদিও এই শুল্ক ভারত বা চীনের ওপর আরোপিত শুল্কের চেয়ে তুলনামূলক কম, তবুও এগুলো যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে এডিবি উল্লেখ করেছে।
উন্নয়ন সহযোগীটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাজারেও বাড়তি প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে, যেখানে হয় দাম কমাতে হবে, নয়তো বাজার হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে।
এ ঝুঁকি সামাল দিতে এডিবি সুপারিশ করেছে, বাংলাদেশকে রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্যময় করতে হবে, নতুন বাণিজ্য চুক্তির পথ খুঁজতে হবে এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হওয়ার পূর্বাভাস
এডিবি বলছে, নতুন বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশ—যা মার্কিন শুল্ক ও সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে গঠিত হচ্ছে—তার প্রভাবে উন্নয়নশীল এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি ধীর হবে।
২০২৫ সালে অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি হবে ৪.৮ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ৪.৫ শতাংশ, যা গত এপ্রিলে দেওয়া ৪.৯ শতাংশ ও ৪.৭ শতাংশ পূর্বাভাসের চেয়ে কম।
মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির পাশাপাশি অনিশ্চিত বাণিজ্য পরিবেশ এ অঞ্চলের প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
অত্র অঞ্চলে মূল্যস্ফীতি চলতি বছরে খাদ্য ও জ্বালানির কম দামের কারণে ১.৭ শতাংশে নেমে আসবে, তবে আগামী বছর খাদ্যদ্রব্যের দাম স্বাভাবিক হলে তা সামান্য বেড়ে ২.১ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
এডিবি আরও সতর্ক করেছে, বাণিজ্য ঝুঁকি এই অঞ্চলের প্রবৃদ্ধির প্রধান হুমকি। যুক্তরাষ্ট্র–চীনের বিদ্যমান উত্তেজনা, সেমিকন্ডাক্টর ও ওষুধে খাতভিত্তিক শুল্ক এবং ভবিষ্যৎ শুল্ক বৃদ্ধি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।