মানিকচানের পোলাও—৭৮ বছর ধরে চলছে যে ঐতিহ্যবাহী খাবার

"অনেকদিন ধরেই আসার পরিকল্পনা ছিল। তবে এতদূর এসে একা খাওয়ায় সেই মজা পাওয়া যায় না, যতটা পাওয়া যায় দলবেঁধে এলে। পোলাওয়ের গন্ধে মনে হচ্ছে দারুণ হবে। তবু না খেয়ে বলা মুশকিল," সেগুনবাগিচা থেকে দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মানিকচানের পোলাও খেতে এসেছেন সেলিম হোসেন। তিনিই বলছিলেন এ কথা।
পুরান ঢাকার দ্বিগুবাবু লেন। চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে মানিকচানের পোলাওয়ের গন্ধ। বিশাল হাঁড়ি আর বড় হাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন মানিকচান। পরনে লুঙ্গি, উচ্চতায় খুব বেশি নন, ভাবলেশহীন মুখ। শরীরের মেদ জানান দিচ্ছে ভোজনরসিক সত্তার কথা। পাশে আরেকটি ডেকচি, তাতে সেই বিখ্যাত পোলাও। পোলাও সামলাচ্ছেন মানিকচানের ছেলে সুখচান। পার্সেল প্যাক করতে ব্যস্ত তার সহকারী।
যদিও সবাই শুধু পার্সেল নেয় না। অনেককে দেখা যায় পাত পেতে খেতে বসতে। তাদের পরিবেশন করছেন মানিকচান ও সুখচান। এ দৃশ্য যেকোনো হোটেলের মতোই। কিন্তু হোটেল-ই যদি না থাকে? হ্যাঁ, মানিকচানের পোলাওয়ের কোনো নির্দিষ্ট দোকানঘর নেই।
যিনি খেতে ভালোবাসেন, রান্নায় পটু এবং পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দা—তাকে ভজহরি মান্না বললেও ভুল হয় না। মানিকচান সেই ভজহরি মান্না। বাংলাদেশের ভোজনপ্রেমীদের কাছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের আলাদা কদর রয়েছে। আর সেই তালিকারই একটি নাম মানিকচানের পোলাও। দোকানঘর না থেকেও স্রেফ রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে এই স্বাদ নিতে।
শুরুর কথা
সময়টা পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকে। মানিকচানের বাবা মিয়াচান ছিলেন রান্নার শৌখিন। অভাবের সংসারে সামান্য উপার্জনের জন্য রাতের বেলা রান্না করে বসতেন দ্বিগুবাবু লেনে। যেসব ট্রাকচালক জিনিসপত্র লোড করে ফিরতেন বেশ রাত করে, তারাই খেতেন মিয়া চানের রান্না। খুশি হয়ে দু-চার পয়সা দিতেন। এভাবে নৈশপ্রহরী থেকে শুরু করে রাত জাগা শ্রমজীবী মানুষের ভরসার জায়গা হয়ে ওঠে মিয়াচানের অস্থায়ী হোটেল।
হোটেল বলা যায় কি? মাথার ওপর খোলা আকাশ, চারপাশে রাস্তা। শুধু ইটের পাঁজায় উঁচু করে রাখা হাঁড়ি। বাসনপত্রও ছিল সামান্য। মেন্যু ছিল সীমিত—পোলাও আর খাসির মাংস।
২ আনা দিয়ে শুরু
সে সময়ে বিরিয়ানির ব্যবসা সবে শুরু হয়েছে। মিয়াচান রান্না শিখেছিলেন পরিচিত এক বিরিয়ানি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। হাতে পুঁজি ছিল কম, কিন্তু রান্নার প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। ছোট পরিসরে ৮-১০ জনের জন্য রান্না শুরু করলেন। পারিশ্রমিক নিতেন দুই আনা। তখন দুই আনারও যথেষ্ট মূল্য ছিল।
সে সময় বাড়ির বাইরের রান্না খাওয়ার প্রচলন শুরু হচ্ছিল। যত দিন গেল, মিয়াচানের রান্নার ক্রেতা বাড়তে লাগল। বছর কয়েকের মধ্যেই পরিচিত মুখ হয়ে উঠলেন তিনি। ছাদ বা বসবার জায়গা ছাড়া সেই অস্থায়ী হোটেলও জমে উঠল।
মানিকচান ছিলেন বাপ-ন্যাওটা ছেলে। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে ঘুরে দেখতেন রান্নাবান্নার যোগাড়-যন্ত্র, কখনোবা রাতের বেলা যেতেন দ্বিগুবাবু লেনে। চুপ করে বসে লক্ষ্য করতেন পরিবেশন থেকে টাকার হিসাব। কখনো ঘুমিয়ে পড়লেও বাবার সঙ্গে আসতেই হবে।
১৯৮০ সালের দিকে মিয়াচানের পোলাও-মাংসের দাম ছিল আনুমানিক ১০-১২ টাকা। খাসির মাংস তখন ৫০ টাকা সের। নিম্নবিত্ত মানুষদের পক্ষে এক সের মাংস কেনা সম্ভব ছিল না। তাই তারা বছরের বিশেষ দিনে সামান্য সঞ্চয় নিয়ে মিয়াচানের কাছে আসতেন মাংসের স্বাদ নিতে।
মানিকচান বয়সে বড় হতে হতে বাবার রান্নায় হাত লাগালেন। পরিবেশনেও সাহায্য করতেন। বাবার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক শক্তি কমে এলে দায়িত্ব নিতে শুরু করেন মানিকচান নিজেই। একদিন আর রইলেন না মিয়াচান।
তবে তার হাতের রান্নার স্বাদ যেন রয়ে গেল। পোলাওয়ের গন্ধ নাকে এলেই পুরোনো খরিদ্দাররা চিনে নেন সেই স্বাদ। শুধু এবার রান্না করছেন মিয়াচানের ছেলে মানিকচান। পৈতৃক ব্যবসা টিকিয়ে বাবাকে জীবিত রেখেছেন তিনি। তখনও জানতেন না কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন এই ব্যবসা। অনিশ্চয়তা ও ভয় ছিল, কিন্তু অভাবই শিখিয়েছিল ভয় জয়ের কৌশল।
তিন বোনের বিয়ের খরচ জোগাতে সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। তাই বাড়তি আয়ই ছিল ভরসা। মানিকচান সেই টাকায় বোনদের বিয়ে দিয়েছেন, মায়ের দেখাশোনা করেছেন। পরে সংসার শুরু, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ—সব সামলেছেন পোলাও রান্না করেই। এখন তাদের ব্যবসার বয়স প্রায় ৭৮ বছর।
৬ দিনে ৬ রকম মেন্যু
শুরুর দিকে মানিকচানও বাবার মতো প্রতিদিন পোলাও-মাংস বিক্রি করতেন। কিন্তু প্রতিদিন একই মেন্যু খানিকটা একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছিল। নিয়মিত ক্রেতাদের কথা ভেবে তৈরি করলেন নতুন নিয়ম—৬ দিনে ৬ রকম রান্না। সব রেসিপিই বাবার কাছ থেকেই শেখা। আজও সেই নিয়ম চলছে।
শনিবার পোলাওয়ের সঙ্গে খাসির রেজালা; রোববার ঝাল খাসি-আলুর ঝোল আর পোলাও; সোমবার খাসির ভুনা পোলাও; মঙ্গলবার খাসি বুটের ডাল আর পোলাও; বুধবার মিয়াচানের পুরোনো রেসিপি—খাসির বিরিয়ানি; বৃহস্পতিবার খাসির ভুনা খিচুড়ি; আর শুক্রবার মানিকচানের ছুটির দিন।
মানিকচানের অস্থায়ী হোটেলের আরেকটি বিশেষত্ব হলো—মাত্র ২০০ টাকায় পেটপুরে খাওয়া যায়। পোলাওয়ের পরিমাণ থাকে বেশি, সঙ্গে মাংসের টুকরোও বড়। দুর্মূল্যের এই সময়ে ২০০ টাকায় পেটপুরে পোলাও-মাংস খাওয়ার সুযোগ কে-ই বা হাতছাড়া করে!
প্রি-অর্ডার ব্যবস্থা
মানিকচানের পোলাওয়ের পুরোনো ক্রেতা ইমরান শরিফ বলেন, বর্তমানে প্রি-অর্ডার ব্যবস্থা চালু হওয়ায় অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে খাবার পান না। "বিকাশে টাকা দিয়ে আগে থেকে অর্ডার না করলে এখন আর খাওয়া যায় না। অথচ মানিকচানের পোলাও শুরু হয়েছিল রাতজাগা শ্রমজীবী মানুষের জন্য। আগে আমার মতো অনেকেই হুট করে চলে আসতেন। এখন সেই সুযোগ নেই।"
তবে মানিকচানের ছেলে জানান ভিন্ন কথা। তার ভাষ্যে, "আগে যখন প্রি-অর্ডার ছিল না, তখন কখনো খাবার কম পড়ত, আবার কখনো নষ্টও হয়ে যেত। এখন ঠিকঠাক হিসাব মেনে রান্না করা যায়। পাশাপাশি টাকাটাও আগে পাওয়া যায়। এতে ঝামেলা দুই পক্ষেরই কমে।"
এখন তাই একদিন আগে বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে অর্ডার করতে হয়। মোবাইল প্রযুক্তি খুব একটা বোঝেন না মানিকচান, অনলাইন অর্ডারের বিষয়গুলো সামলান তার ছেলে।
সময়ের পালাবদল
দু'বছর আগেও মানিকচানের পোলাও বিক্রি হতো গভীর রাতে। রাত তিনটা থেকে ভোর পর্যন্ত মিডফোর্ড রোডের দ্বিগুবাবু লেনে ভিড় জমত মানুষের। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যেত ভোজনরসিকদের কোলাহলে। তবে সেই আড্ডায় জায়গা হতো না মেয়েদের—কারণ হোস্টেল বা বাড়ি থেকে রাতদুপুরে পুরান ঢাকা আসা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
গত বছর মানিকচান সময়সূচি বদলেছেন। এখন তিনি বসেন রাত নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যে, আর তল্পিতল্পা গোটান সর্বোচ্চ সাড়ে এগারোটার মধ্যে। ফলে এবার সুযোগ পাচ্ছেন সেইসব নারী ক্রেতারাও, যারা আগে নিরাপত্তার কারণে আসতে পারতেন না। যদিও কেউ কেউ এখনো খুঁজে ফেরেন সেই মাঝরাতের ভিড় আর অপেক্ষার দৃশ্য।
সোশ্যাল মিডিয়ার হাইপ
ইন্টারনেটের যুগে ফুড ভ্লগার এখন পরিচিত শব্দ। সেই ভ্লগারদের হাত ধরে মানিকচানের পোলাওয়ের নাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। আর মুখে মুখে সীমাবদ্ধ নেই, ইউটিউব-ফেসবুকের ভিডিওর কল্যাণে পৌঁছে গেছে দূর-দূরান্তে।
তবে এসব ভিডিও অনেক সময় অযথাই প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয়, যা ব্যবসায়ীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আসলেই মানিকচানের রান্নার তুলনা চলে না কোনো দামি রেস্তোরার তিনগুণ দামের খটমট নামের ডিশের সঙ্গে। যেমন তুলনা চলে না মায়ের হাতের রান্নার সঙ্গে পাঁচতারা হোটেলের খাবারের।
একজন ক্রেতা বললেন, "পুরান ঢাকার ঘুপচি গলিতে মানিকচানের রান্না খাওয়ার আমেজটাকে যদি পাঁচতারা হোটেলের সঙ্গে মেলাতে চান, তাহলে হতাশ হবেনই। তবে দাম অনুযায়ী বিচার করলে মানিকচানের পোলাও গড়পড়তার চেয়ে অনেক ভালো।"
তিন পুরুষের ব্যবসা
মানিকচানের ছেলে এখন বাবার সঙ্গে থেকে থেকে ব্যবসার অনেকটা দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। রান্নাবান্নাতেও হাত পাকাচ্ছেন তিনি। দাদার আমলে বাড়তি আয় করার আশায় শুরু হয়েছিল যে ব্যবসা, মানিকচানের হাতে সেটি আরও বড় রূপ নেয়।
এখন বয়সের ভারে মানিকচান অনেকটাই ক্লান্ত। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে মাঝেমধ্যেই নস্টালজিক হয়ে পড়েন। মনে ভেসে ওঠে বাবার মুখ, সেই পুরোনো ডেকচি, খুন্তি-হাঁড়ি, অস্থায়ী রসুইঘর। এই রসুইঘরের দৌলতেই তিন পুরুষ ধরে দুই বেলা অন্ন জুটেছে মিয়াচান-মানিকচানদের পরিবারে।
এখন মানিকচানের ছেলে সুখচানও এগিয়ে আসছেন সেই পথে। তার স্বপ্ন—তিন পুরুষের ব্যবসাকে আরও বড় করে তোলা। মাথার ওপর একখানা ছাদ, কিছু বসবার জায়গা, আর একটি ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে 'মানিকচানের পোলাও'।
তবে হোটেল বানানোর এই পরিকল্পনায় এখনো রাজি নন মানিকচান। তিনি হেসে বলেন, "দোকান ভাড়া, পজিশনের বাড়তি খরচ যোগ হলে আর এত কম দামে খাবার দেওয়া যাবে না। আর খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে খাওয়ার এই মজাটাও তখন হারিয়ে যাবে।"
ছবি কৃতজ্ঞতা: তীর্থ বন্দ্যোপাধ্যায়