মার্কিন নৌবাহিনীর হামলায় নিহত ১৭; জবাবে নাগরিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে ভেনেজুয়েলা

যখন এডিথ পেরালেস তরুণ ছিলেন, সেসময়ই তিনি জাতীয় বলিভারিয়ান মিলিশিয়ায় যোগ দেন। এই বাহিনীটি ২০০৯ সালে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ গঠন করেন। এটি একটি বেসামরিক বাহিনী, যার উদ্দেশ্য ভেনেজুয়েলাকে রক্ষা করা।
বিবিসির প্রতিবেদনে চাভেজের সেসময়ের বক্তব্য উঠে এসেছে। সেই সময় চাভেজ বলেছিলেন, 'আমাদের এমন একটি দেশ হতে হবে, যেখানে আমরা আমাদের ভূখণ্ডের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করতে সক্ষম হবো, যাতে কেউ এসে আমাদের সঙ্গে ছলচাতুরী করতে না পারে।'
১৬ বছর পর ৬৮ বছর বয়সি পেরালেস যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতি নিতে হাজার হাজার মিলিশিয়া সদস্যের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন।
এই মিলিশিয়া বাহিনীটি এখন বেশ অগোছালো ও সীমিত সরঞ্জামসম্পন্ন এবং এর সদস্যদের অধিকাংশই প্রবীণ নাগরিক। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী দক্ষিণ ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করার পর তাদের ডাকা হয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এই অভিযানটি মাদকবিরোধী কার্যক্রমের অংশ, তবে ভেনেজুয়েলা এটিকে সম্ভাব্য সামরিক হুমকি হিসেবে দেখছে।
মার্কিন বাহিনী ইতোমধ্যেই মাদক থাকার অভিযোগে তিনটি নৌকা ধ্বংস করেছে। তাদের দাবি, নৌকাগুলো ভেনেজুয়েলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক বহন করছিল। এ ঘটনায় অন্তত ১৭জন নিহত হয়েছেন।

ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো বলেছেন, এই হামলা ও মার্কিন নৌবাহিনী মোতায়েনকে একত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে একটি 'ঘোষণাবিহীন যুদ্ধ'-এর সমান। এরপর প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো দ্রুতই মিলিশিয়া বাহিনীকে সক্রিয় করার আহ্বান জানান।
এদিকে, পেরালেস ইতোমধ্যে তার ইউনিফর্ম ও জুতা প্রস্তুত রেখেছেন—নিজের 'দুর্গ' অর্থাৎ কারাকাসের যে এলাকায় তিনি থাকেন, সেটিকে রক্ষা করার জন্য।
তিনি কারাকাসের '২৩ দে এনরো' এলাকায় থাকেন—রাজধানীর এমন এক অঞ্চল, যা ঐতিহ্যগতভাবে চাভেজবাদ (চাভিসমো)-এর ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের প্রতিষ্ঠিত এই বামপন্থী মতাদর্শই পরে তার মনোনীত উত্তরসূরি নিকোলাস মাদুরো গ্রহণ করেন।
সরকারের একজন অনুগত সমর্থক পেরালেস বলেন, 'যখনই আমাকে ডাকা হবে, আমি সেবার জন্য প্রস্তুত'।
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে হবে।' এই বক্তব্যের সুর প্রেসিডেন্ট মাদুরোর সাম্প্রতিক ভাষণের সঙ্গে মিলে যায়—যা তিনি নৌকা ধ্বংসের ঘটনার পর দিয়েছেন।
বিবিসিকে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দক্ষিণ ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন নৌবাহিনীর মোতায়েনের পরিমাণ যথেষ্ট বড় হলেও, এটি এতটা নয় যে সেটিকে পরিকল্পিত আগ্রাসনের অংশ হিসেবে ধরা যায়।
তবে এতে সন্দেহ নেই যে, ভেনেজুয়েলা ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক—যা দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনাপূর্ণ—ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে নিকোলাস মাদুরোর পুনর্নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেয়নি। তারা বলছে, ভেনেজুয়েলার বিরোধী দল ও স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের সহায়তায় সংগৃহীত প্রমাণ অনুযায়ী, মাদুরোর প্রতিদ্বন্দ্বী এডমুন্ডো গনসালেজ বিপুল ভোটে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় ফিরে আসার পরপরই ভেনেজুয়েলার অপরাধী গোষ্ঠী 'ত্রেন দে আরাগুয়া'-কে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করেন। এই সিদ্ধান্তকে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের বহিষ্কারের বৈধতা হিসেবে ব্যবহার করছেন, পাশাপাশি সম্প্রতি ক্যারিবীয় অঞ্চলে নেওয়া সামরিক পদক্ষেপের যৌক্তিকতাও হিসেবে তুলে ধরছেন।
ট্রাম্প প্রশাসন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে মাদক কার্টেলের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ এনেছে এবং তার গ্রেপ্তারের জন্য তথ্য প্রদানকারীদের পুরস্কার দ্বিগুণ করে ৫ কোটি ডলার (৩৭.৩ মিলিয়ন পাউন্ড) ঘোষণা করেছে।
মাদুরো দৃঢ়ভাবে ওয়াশিংটনের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং তার সরকারের মাদকবিরোধী পদক্ষেপের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।
তবে এই বিরোধপূর্ণ অবস্থার মধ্যেও মাদুরো সরকার ট্রাম্প প্রশাসনকে সহযোগিতা করেছে—যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কৃত ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের ফেরত নেওয়ার মাধ্যমে। মার্কিন কর্মকর্তারা এসব অভিবাসীর অনেককেই গ্যাং সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত করেছিলেন।

প্রথম নৌকা হামলার পর প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো তার মার্কিন সমকক্ষের কাছে এক চিঠি পাঠান, যেখানে তিনি বৈঠকের আহ্বান জানান। তবে হোয়াইট হাউস সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
তবু দেশের ভেতরে মাদুরোর বক্তব্য রয়ে গেছে লড়াকু ও আক্রমণাত্মক।
তিনি ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনী—ন্যাশনাল বলিভারিয়ান আর্মড ফোর্সেস (এফএএনবি)-কে নির্দেশ দিয়েছেন স্থানীয় মিলিশিয়াদের প্রশিক্ষণ দিতে, যার মধ্যে এডিথ পেরালেসের বাহিনীও রয়েছে।
এই মিলিশিয়া দলগুলোর সদস্যরা মূলত দরিদ্র সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবক। তবে সরকারি চাকরিজীবীদেরও অনেক সময় এসব দলে যোগ দিতে চাপের মুখে পড়তে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
অতীতে এই মিলিশিয়া বাহিনীকে মূলত রাজনৈতিক সমাবেশ ও শোভাযাত্রায় জনসমাগম বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
এই বাহিনীর সদস্যরা সাধারণত বয়সে অনেক বয়স্ক। তবে ভয়ঙ্কর হিসেবে পরিচিত 'কো'লেক্তিভোস' থেকে আলাদা—এরা কঠোর সরকারপন্থি গোষ্ঠী, যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে এবং যাদের প্রায়ই বিরোধী দলের বিক্ষোভ ভাঙতে ব্যবহার করা হয়।
যে যুক্তরাষ্ট্রকে তারা হুমকি হিসেবে দেখছে, তার মুখোমুখি হয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন ও অস্থির হয়েই মাদুরো সরকার এখন মিলিশিয়া বাহিনীকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
শনিবার বিকেলে সৈন্যরা কারাকাসের পেতারে এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে—মাদুরোর দেওয়া নির্দেশ 'ছাউনিগুলোকে জনগণের কাছে নিয়ে যাও' বাস্তবায়নের জন্য।
এই সৈন্যদের কাজ হলো স্থানীয়দের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে তারা 'শত্রুর' মোকাবিলা করতে প্রস্তুত থাকতে পারে।
প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে ট্যাংক, রাশিয়ান উত্পাদনের রাইফেলের উপস্থিতি দেখা গেছে। তবে সেগুলো লোড করা নেই। এছাড়া রয়েছে ও রয়েছে নির্দেশনামূলক পোস্টার।
একজন সৈন্য লাউডস্পিকারে একটি ছোট দলকে নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, 'গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অস্ত্রগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া। আমরা লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করি এবং সেগুলোকে আঘাত করি।'
প্রশিক্ষণ চলাকালীন, পুরো এলাকাজুড়ে সবাই—মহিলারা ও শিশুরাও—তার বক্তব্য শুনছেন।

প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের অধিকাংশের অস্ত্র ব্যবহার বা যুদ্ধে অংশগ্রহণের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তবে তারা অভিজ্ঞতার অভাব পূরণ করছেন উৎসাহ ও দৃঢ় মনোবল দিয়ে।
এলাকার এক অংশগ্রহণকারী ফ্রান্সিসকো ওজেডা বিবিসি নিউজ মুন্ডোকে বলেন, 'যদি যুদ্ধে আমার জীবন দিতে হয়, আমি দেবই।'
ওই ৬৯ বছর বয়সী ব্যক্তি রোদে পোড়া টারম্যাকের উপর নিজে ঝাঁপিয়ে পড়েন ও একে-১০৩ রাইফেল আঁকড়ে ধরে লড়াইয়ের ভঙ্গি করতে থাকেন। একজন সৈন্য তার ভঙ্গি ঠিক করে দেন।
তিনি বলন, 'এখানেই বিড়ালরাও বেরিয়ে এসে গুলি করবে, আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য।'—এই অতিশয্জীবক্তব্যটি দেখায় যে সবাই, এমনকি অপ্রত্যাশিত ব্যক্তিরাও, রাষ্ট্র রক্ষায় অস্ত্র হাতে তুলতে পারে বলে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
৬৭ বছর বয়সী গ্ল্যাদি রদরিগেসও সমানভাবে আগ্রহী। তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'আমরা কোনো যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে এসে আক্রমণ করতে দেব না।'
বাড়ির গৃহিণী ৩৮ বছর বয়সী ইয়ারেলিস হাইমেস একটু বেশি দ্বিধাগ্রস্ত। তিনি বলেন, 'এমন একটি অস্ত্র ধরা আমার জন্য প্রথম। আমি একটু নার্ভাস অনুভব করছি, কিন্তু জানি আমি সেটা করতে পারব।'
তবে পেটারে লোকজন রাইফেল চালানো শিখলেও, মাদুরোর ঘাঁটিগুলোর বাইরে সাধারণ জীবন আগের মতোই চলছে—অনেকে আক্রমণের সম্ভাবনা নিয়ে তেমন ভাবছে না।
ফ্রান্সিসকো ওজেডা যেখানে ধূলিমাখা রাস্তায় অবস্থান গ্রহণ করছিলেন, তার ক'মিটার দূরত্বে সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যস্ত।
রাস্তার বিক্রেতারা পণ্য সাজাচ্ছেন, অন্যরা শনি-রোববারের কেনাকাটা সারছেন। তারা মিলিশিয়াদের কর্মকাণ্ডের দিকে চোখ তুলেও তাকাচ্ছেন না।
অ্যান্ড্রেস বেল্লো ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক বেনিগ্নো আলারকন বলেন, মাদুরোর মিলিশিয়া পরিকল্পনার লক্ষ্য যুদ্ধ করার নয়, বরং এটি 'মানব ঢাল' হিসেবে কাজ করবে।
অধ্যাপক আলারকন বলেন, সাধারণ মানুষকে মিলিশিয়ায় ডেকে মাদুরো সরকার যেকোনো সম্ভাব্য মার্কিন সামরিক অভিযানের মানবিক খরচ বাড়াতে চায়, কারণ নাগরিক উপস্থিতি মৃত্যুর সম্ভাবনাকে অনেক বেশি করে তোলে।
তার মতে, মিলিশিয়ারা ভাল প্রশিক্ষিত না হওয়া বা অস্ত্রহীন হওয়াও কোনো সমস্যা নয়, কারণ তাদের স্রেফ উপস্থিতি হামলাকারীর জন্য ঝুঁকি বাড়ায়।
মাদুরো দাবি করেছেন, ৮.২ মিলিয়নেরও বেশি নাগরিক মিলিশিয়া এবং রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত, তবে এই সংখ্যাটি বিস্তৃতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
পেরালেস, যারা বহু বছর ধরে মিলিশিয়ায় আছেন, নিজেকে তার রাস্তাটির, যে এলাকায় তিনি থাকেন—সেই প্রতিবেশের 'রক্ষক' হিসেবে দেখেন।
যদিও অতীতে তিনি বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। তবে বয়স ও স্বাস্থ্যজনিত কারণে সাম্প্রতিক কারিগরি অনুশীলনগুলো থেকে তিনি দূরে ছিলেন।
তবুও তিনি বলেন, যদি কোনো সংঘর্ষ ঘটে, তিনি প্রস্তুত: 'আমাদের ভূখণ্ড রক্ষা করতে হবে। ইউনিফর্ম পরলেই একটি দায়িত্ব তৈরি হয়।'