আবাসন খাতের মন্দায় সংকুচিত ৬,৫০০ কোটি টাকার ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বাজার

নতুন নির্মাণ বিধিনিষেধের কারণে দেশের আবাসন খাতে যে মন্দা দেখা দিয়েছে, তার ফলে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ফিটিংসের চাহিদা ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, এ পরিস্থিতি দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানীয় উৎপাদন শিল্পে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রায় ৫ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবাসন বাজারের এই সংকোচন ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যের খাতকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অথচ এই খাতটি সফলভাবে আমদানি-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে স্থানীয় উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক পরিচালক মাহবুব হাসান সরকার টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল পণ্যের বাজার মূলত আবাসন খাতের ওপর নির্ভরশীল। আগে ব্যবসা ভালো ছিল, কিন্তু গত এক বছরে বিক্রি অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে।'
ঢাকার পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ফ্যান, লাইট, সুইচ, ওয়্যারিং, সকেট, হোল্ডার, মাল্টি-প্লাগ, সার্কিট ব্রেকার, মিটার ও অন্যান্য ফিটিংসের বিক্রি অনেক কমে গেছে ।
উদাহরণস্বরূপ, কাপ্তান বাজারের আলিফ ইলেকট্রনিক্স জানায়, তাদের সাপ্তাহিক বিক্রি ২০ লাখ টাকা থেকে কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। ডেভেলপার ও ঠিকাদারদের আনাগোনাও এখন আর আগের মতো নেই। কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা সগির হোসেনও ব্যবসায় এমন মন্দা নিয়ে একই ধরনের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।
মন্দার কারণ
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া জানান, এই মন্দার মূল কারণ হলো বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধন। এই পরিবর্তনের ফলে ছোট প্লটে ভবনের উচ্চতা সীমিত করে দেওয়া হয়েছে, যা নতুন নির্মাণ কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা এখন ফ্ল্যাট তৈরি করছি না। আমাদের কার্যক্রম ৭০ শতাংশ কমে গেছে।' কর্তৃপক্ষকে বারবার অনুরোধ করেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
লিয়াকত আলী বলেন, এর বিরূপ প্রভাব সুদূরপ্রসারী, যা কেবল ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বাজারেই নয়, একইসঙ্গে স্টিল, সিমেন্ট ও রঙের মতো আরও কয়েক ডজন খাতেও পড়ছে।
বাজারের আকার ও কর্মসংস্থান
মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের প্রাক্কলন অনুসারে, ২০২৪ সালে দেশে ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জাম ও আলোকসজ্জা পণ্যের সম্মিলিত বাজারের আকার প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে সুইচ, সকেট, হোল্ডার ও প্লাগের মতো ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জামের বাজার ৩ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকার। আর এলইডি ও ইমার্জেন্সি লাইটসহ আলোকসজ্জা পণ্যের বাজার ২ হাজার ৯২৫ কোটি টাকার।
এই খাতে দেশব্যাপী ১ লাখ ৫০ হাজার খুচরা বিক্রেতা ও ২ হাজার ৫০০ উদ্যোক্তাসহ মোট ৫ লাখের বেশি মানুষ কর্মরত।
ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জাম খাতে সুপারস্টার (২৯ শতাংশ বাজার হিস্যা), ওয়ালটন (১৭ শতাংশ) ও ক্লিক (১৭ শতাংশ) প্রধান প্রতিষ্ঠান। ব্র্যান্ডেড আলোকসজ্জা পণ্যের বাজারে ২৫.৫৯ শতাংশ হিস্যা নিয়ে শীর্ষে রয়েছে সুপারস্টার। এরপরেই আছে ক্লিক (১৩ শতাংশ) ও ওয়ালটন (১২ শতাংশ)।
পণ্যের বৈচিত্র্য বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুরক্ষা দিচ্ছে
পুরো শিল্পজুড়ে মন্দা সত্ত্বেও কিছু বড় কোম্পানি পণ্যের বৈচিত্র্যায়নের মাধ্যমে তাদের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পেরেছে। তবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের পণ্যের দামই কিছুটা বেড়েছে।
ওয়ালটন ক্যাবলের চিফ বিজনেস অফিসার রাজু আহমেদ বাজারের খারাপ পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, '২০২০ সালের আগে খাতটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ শতাংশের বেশি... গত বছরের তুলনায় পুরো খাতের বিক্রি ২০-২৫ শতাংশ কমেছে।'
তবে তিনি আরও বলেন, 'পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং ক্রমাগত উদ্ভাবন নতুন গ্রাহক আকর্ষণে সহায়তা করেছে।'
একইভাবে বিআরবি ক্যাবলের পরিচালক (মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস) রফিকুল আলম রনি জানান, তাদের ব্যবসা 'তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল' রয়েছে। তিনি বলেন, আবাসন খাতের মন্দা তাদের খুব বেশি প্রভাবিত করেনি।
রফিকুল আরও বলেন, পরিচালন ব্যয় বাড়ায় পণ্যের দাম ১০-১২ শতাংশ বাড়াতে হলেও পণ্যের বৈচিত্র্য ও নতুনত্বের কারণে তাদের কোম্পানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছে।