‘লাঞ্চের পরে আসেন’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলগুলোর সিট বণ্টন যেভাবে চলে

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মফস্বল কিংবা শহরের মেধাবী শিক্ষার্থীরা ইচ্ছুক থাকেন। কিন্তু শুধু তো ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ব্যাপার নয়, আসল ভর্তিযুদ্ধ তো শুরু হয় লাখ লাখ পরীক্ষার্থীকে হারিয়ে পরীক্ষায় টিকে একখানা সিট নিশ্চিত করবার ঠিক পর থেকেই।
দেশ যতই ডিজিটাল হোক না কেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ভর্তি প্রক্রিয়ার সাবেকিয়ানা ঠিকই ধরে রেখেছে। রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের 'লাঞ্চের পরে আসেন' থেকে এ ব্যাংক ও ব্যাংকে ছুটোছুটি, কাগজপত্র নিয়ে হল-ডিপার্টমেন্টে ছুটোছুটি — ভর্তি যেন সত্যিকার অর্থেই এক যুদ্ধ।
এখানেই শেষ নয়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে কথা! এই বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে প্রথম থেকেই তাকে ছুটোছুটিতে দক্ষ করে তোলে। তাই ভর্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়রানির যে সূচনা ঘটে, তা চলতে থাকে পাশ করে বের হয়ে সার্টিফিকেট তোলা পর্যন্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে সিট পাওয়া আরেক দীর্ঘতম সংগ্রাম। মেয়েদের হলগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিটা সেশনে দুই থেকে চারটি কলের মাধ্যমে ছাত্রীরা সিট পেয়ে থাকেন। তবে এই কলের মাধ্যমে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীকেই সিট দেওয়া সম্ভব হয়।
বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দরখাস্ত জমা না দিলে অনেক শিক্ষার্থীকে বিপদে পড়তে হয়। অপেক্ষা করতে হয় আরেকটি বছরের। এসবের বাইরেও একটি বড় অংশের সিট ছিল কেবল রাজনৈতিক পরিচয়ে। ছাত্রলীগে নাম লেখালে রাজনৈতিকভাবে হলে ওঠার এক অলিখিত ধারা চালু ছিল বিগত ১৫ বছর।
রাজনৈতিক পরিচয়ে সিটপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের জীবনের গল্পে যতটা না রাজনৈতিক সচেতনতা থাকে, তার থেকে বহুগুণে থাকে অভাব, মাথা গোঁজার ঠাঁই জোটানোর তাগিদ। তারপর পড়াশোনার বদলে মিটিং-মিছিল, নেত্রীদের ফাইফরমাশ খাটা হয়ে যেত তাদের নিত্য জীবনের অংশ।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই রাজনৈতিক সিটের শুরুটা কিন্তু ১৫ বছর ধরে নয়, বরং দেশ স্বাধীনের পর থেকেই।
১৯৭৭-৭৮ সেশনের জগন্নাথ হলের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল তৎকালীন সময়ের হলের সিট বণ্টন প্রক্রিয়া নিয়ে।
তিনি বলছিলেন, "তখন নম্বর ও ইয়ারের ভিত্তিতে নিয়ম অনুযায়ী সিট দেওয়া হতো। হল থেকে সিটের জন্য নোটিশ প্রকাশ করা হতো। সেই নোটিশে উল্লিখিত নিয়মে দরখাস্ত এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হতো। কাগজপত্র নিয়ে ছুটোছুটি, ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়াসহ নানা প্রক্রিয়া তো ছিলই।
"প্রথম বর্ষে সিট পেতেন একমাত্র প্রতিবন্ধী কিংবা এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া দু-চারজন। সমস্ত টপারও সিঙ্গেল সিট পেতেন না প্রথম বর্ষেই। তাদেরকে অপেক্ষা করতে হতো দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত। আর অন্যরা নম্বরের ভিত্তিতে দ্বিতীয় বর্ষে বা তারও পরে সিট পেতেন।"
"হল কর্তৃপক্ষ এই সিট বণ্টনের দায়িত্ব পালন করত। ৯৫ শতাংশ সিট হতো মেধা ও বর্ষের ভিত্তিতে নিয়ম মেনে। বড় খেলোয়াড় ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এসব ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় পেতেন," যোগ করেন তিনি।
তবে দলবাজির জোরে কিছু রুম দখলের রীতি তখনও চালু ছিল। ওরা অধিকাংশই ছিল কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা। এই সমস্ত রুমে সিট বণ্টন নিয়ম অনুযায়ী হতো না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রায় সকলেই তাদের ঘৃণা করত এবং এড়িয়ে চলত।

ছাত্র ইউনিয়ন কিছু সিট বিনিময়ের মাধ্যমে দু-চারটি রুম নিজেদের করত, সিট সংকট কমিয়ে ডাবলিং-ফ্লোরিংয়ের সুবিধা দেওয়ার জন্য। চার সিটের রুমে ১২-১৩ জন উপরে-নিচে (ফ্লোরে) মিলিয়ে থাকতেন। কয়েকটি রুমের সাইজ বড় হওয়ায় সাত-আট সিটে থাকতেন ১৬-১৭ জন।
এতজন একই রুমে থাকায় সবাই টেবিলে বসে পড়তে পারতেন না। তবে ক্লাস টাইমের ভিন্নতা বুঝে যে যখন সময় পেতেন, সেই অনুযায়ী টেবিল ব্যবহার করতেন কেউ কেউ বন্ধুর রুমেও গিয়ে পড়াশোনা করতেন।
সিটের অভাব ছিল তখন প্রকট। ধনী কোনো কোনো শিক্ষার্থী বাসা ভাড়া করেও থাকতেন। তবে বেশিরভাগই হলে থাকতেন — আনন্দ ও পড়াশোনা বিষয়ক আলোচনার সুবিধা পেতে।
শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে হাউস টিউটর স্যাররা রুমে রুমে ঢুকে পড়াশোনা হচ্ছে কি না, তা দেখতেন। সিট ভাড়া ছিল বছরে ৬০-১০০ টাকা। তবে ফ্যান লাগানোর নিয়ম ছিল না। নিয়ম ভেঙে নিজ উদ্যোগে দু-চারজন রুমে ফ্যান লাগাতেন। কেউ কেউ রান্নার জন্য হিটার ব্যবহার করতেন। ধরা পড়লে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হতো। হিটার অনেক ছিল, তবে ফ্যান দুচারটি মাত্র। কোনো রুমে ডাবলিং-ফ্লোরিং করলেও হল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হতো।
১৯৯৯-২০০০ সেশনের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান মাসুমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল সে সময়ের সিট বণ্টন ব্যবস্থা নিয়ে। তিনি জানালেন, তাদের সময়েও বৈধভাবে সিট পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল সীমিত। অনেক ক্ষেত্রে সিট পেলেও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ সে সিট দখল করতেন।
অর্থাৎ সিট একজনের নামে, কিন্তু থাকতেন অন্যজন। এ ধরনের সমস্যার সমাধান হিসেবে কেউ থাকতেন রাজনৈতিক সিটে, কেউ বা পরিচিত বড়ভাইয়ের সঙ্গে ডাবলিং করতেন। এভাবে চারজনের সিটেও একেক রুমে ১০-১৫ জন করে থাকতে হতো।
বর্তমান বছরগুলোতে হলের সিট বণ্টনের ক্ষেত্রে আরেকটি ধারা দেখা যাচ্ছে — রেফারেন্স। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষক, ডিপার্টমেন্টের চেয়ারপারসন কিংবা অন্য কোনো ক্ষমতাশালী ব্যক্তির সূত্র ধরে হলে সিট পাওয়ার এই ধারা চালু হয়েছে।
যেহেতু বছরের নির্দিষ্ট সময়ে দরখাস্ত জমা দেওয়ার ধরা-বাঁধা নিয়ম থাকে, নবীন শিক্ষার্থীরা অনেক সময়েই সঠিক সময়ে আবেদনের সুযোগ হারিয়ে ফেলেন। রেফারেন্সিং-এর মাধ্যমে তাই অন্য সময়ে দরখাস্ত দিয়ে অনেকটাই কম ঝামেলায় হলে সিট পাওয়া সম্ভব হয়।
এক্ষেত্রেও হয়রানি যে কম, তা কিন্তু নয়।
বিভাগীয় চেয়ারপারসনের স্বাক্ষর, যে শিক্ষকের রেফারেন্সে উঠতে চান তার স্বাক্ষরসহ লিখিত দরখাস্ত, এসএসসি ও এইচএসসি মার্কশিটের ফটোকপি, পিতার আয়ের সনদ, অভিভাবক ও স্থানীয় অভিভাবকের ছবি ও স্বাক্ষর — এসব সত্যায়িত করে হলের হাউস টিউটরের অফিসে জমা দিতে হয়।
স্থানীয় অভিভাবক আবার যে কেউ হতে পারবেন না — ঢাকার স্থানীয়, রক্তের সম্পর্কের কেউ এবং তাকে অবশ্যই বিবাহিত হতে হবে।
হলের সিট নিশ্চিত হলে হাউস টিউটরের অফিস থেকে শিক্ষার্থীকে ফোন দেওয়া হয়। ২৪ ঘণ্টার নোটিশে শিক্ষার্থীর অভিভাবক ও স্থানীয় অভিভাবকের সাক্ষাৎকার নেন হাউস টিউটর।

কোনো কারণে এই তারিখে তারা উপস্থিত হতে না পারলে সিট বাতিল হয়ে যায়। অথচ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো থেকে ঢাকা আসতেই যেখানে স্থানভেদে সময় লাগে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা, সেখানে বৈধ অভিভাবকের শারীরিক অসুস্থতা বা কর্মস্থলের চাপ থাকা স্বাভাবিক।
কিন্তু সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয় না। কারণ, এটা তো আর যে-সে বিশ্ববিদ্যালয় নয় — এ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! আবাসিক হলে শিক্ষার্থীর মাথার ওপর ছাদের ব্যবস্থা যখন করে দিচ্ছে, তখন বৈধ অভিভাবক কেন ২৪ ঘণ্টার নোটিশে হাজিরা দিতে পারবেন না?
অবশ্য না পারলেও এ বিশ্ববিদ্যালয় বসে থাকে না। আরেকজনকে সেই সিটটা দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। সময়, স্রোত আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ — কারো জন্য অপেক্ষা করে না।
যাই হোক, যদি দুই অভিভাবক (স্থানীয় এবং বৈধ) সময়মতো পৌঁছে সাক্ষাৎকার দিতে পারেন, তবুও কিন্তু তল্পিতল্পা গোটানোর সুযোগ নেই।
এরপর শিক্ষার্থীকে হলের ছাপাকৃত কাগজে নাম ও টাকার পরিমাণ লিখে তা জনতা ব্যাংকে জমা দিতে হয়। এই টাকার একটি রশিদ হল অফিসে জমা দিতে হয়, আরেকটি নিজের কাছে রাখতে হয় প্রমাণস্বরূপ।
এখানেও শেষ নয়। শিক্ষার্থীকে এবার হলের আবাসিক কার্ড বানাতে হয়। সেজন্য প্রয়োজন পড়ে প্রথম বর্ষের ভর্তি স্লিপ, হলে আবাসিক হওয়ার বাবদ টাকা জমা দেওয়ার রশিদ, স্ট্যাম্প সাইজের দুই কপি ছবি।
এসব কাগজপত্র হল অফিসে জমা দেওয়ার পর হল নামাঙ্কিত কাগজে নাম ও পরিচয় লিখে ১০ টাকা জমা দিতে আবার ছুটতে হয় জনতা ব্যাংকে। এরপর এই রশিদ আবার হল অফিসে জমা দিলে তার তিন থেকে চার দিনের মধ্যে হাতে পাওয়া সম্ভব হয় শিক্ষার্থীর আবাসিক পরিচয়পত্র।
সিট যারা পেলেন, তাদের মধ্যেও আবার বৈষম্যের অন্ত নেই। কেউ পান সবচেয়ে সুবিধাসম্পন্ন ভবনে সিট, কেউ পান সবচেয়ে পুরোনো, ভাঙাচোরা ভবনে।
যদিও সবচেয়ে ভালো ভবনে সিট পাওয়ার ক্ষেত্রে সহ-শিক্ষা কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হয় — এমন একটি নোটিশ দেওয়া হয়, কিন্তু তার বাস্তব প্রয়োগ যে খুবই কম, তা একজন আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে আমি বেশ ভালোভাবেই জানি।
২০২৩-২৪ সেশনের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থী সুস্মিতা সাহা চৈতী। তার ফুসফুসসংক্রান্ত মারাত্মক অসুস্থতা রয়েছে। অনেক দৌড়ঝাঁপের পর অপরাজিতা ভবনের তৃতীয় তলায় বৈধ সিট পায় সে। তখনও ঠিক মারাত্মক অসুস্থতা ছিল না — উচ্ছল মেয়ে ছিল চৈতী।
কিন্তু ধীরে ধীরে তার শরীরে নানারকম জটিলতা দেখা দিতে থাকে। সারাক্ষণ জ্বর, কাশির মতো উপসর্গ লেগেই থাকে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে রুমের সবার কাছ থেকেই সে ধীরে ধীরে একঘরে হয়ে পড়ে।

একদিকে অসুস্থতা, অন্যদিকে ভবনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, হলের বেড শেয়ারিং। অসুস্থতার মাত্রা অনুযায়ী সে একটি সিঙ্গেল সিট পেলেও, তার জন্য তাকে অসুস্থ শরীর নিয়েই এই শিক্ষক থেকে সেই শিক্ষক, এই ডিউটি টাইম থেকে অন্য ডিউটি টাইম, দরখাস্ত থেকে শুরু করে মেডিকেল রিপোর্ট জমা দেওয়া পর্যন্ত হাজারো ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
চৈতীর ভাষ্যে, "জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসে, তবু ফুরোয় না ফরমালিটিজ। যাদের শারীরিক অসুস্থতা থাকে, তারা ঠিক কোন উপায়ে এতটা দৌড়াদৌড়ি করতে পারে, তা আমার জানা নেই। তবে উপায় থাকে না বলেই হয়তো মানুষ একটা সিটের জন্য এতটা চেষ্টা করে।"
রোকেয়া হলের ৭ মার্চ ভবনে প্রতিটি ফ্লোরে রিডিং রুম, একাধিক রান্নাঘর, বেশি সংখ্যক টয়লেট ও গোসলখানার ব্যবস্থা থাকলেও অন্যান্য ভবনগুলো একেবারেই উপেক্ষিত। পুরোনো ভবনগুলোর দেওয়াল-ছাদ খসে পড়ার মতো ঘটনাতেও তেমন কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
এমনকি যেখানে অন্য ভবনগুলোতে সিঙ্গেল বেড দেওয়া হয়, সেখানে ৭ মার্চ ভবনে দেওয়া হয় সেমি ডাবল বেড।
অপরাজিতা ভবনের শিক্ষার্থীরা অনেকেই খোলামেলা পরিবেশ, আলো-বাতাস থেকে বলতে গেলে বঞ্চিত। এরপর রয়েছে অপরিষ্কার টয়লেট, সুইপারদের গড়িমসি, পানির ফিল্টারের অব্যবস্থাপনা।
কাপড় ধোয়ার ওয়াশিং মেশিনের প্রশ্নে যখন প্রস্তাব আসে, তখন অন্য তিনটি ভবনের নাম উঠে এলেও, অপরাজিতা ভবনের নাম ওঠে না।
এ যেন একই রাজার দুই রানি — দুয়োরানি আর শুয়োরানি। শুয়োরানিকে রাজা চোখে হারান, আর দুয়োরানি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোও চেয়ে চেয়ে পান না।
তবু রেজাল্টের ক্ষেত্রে খারাপ বিল্ডিং, কম রিডিং রুম কিংবা ময়লা টয়লেট কোনো কিছুই বিবেচনায় আসে না। তখন দাড়িপাল্লার মতো সমানভাবে চোখ বুজে মাপা হয় সমস্ত শিক্ষার্থীদের।
শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌসের ভাষ্যে, এক্সটেনশন ভবনে রান্নাঘর ও বাথরুমের সুবিধা বেশ ভালো। তবে প্রতিটি রুমে ৮ জন করে থাকেন। প্রথম বর্ষ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত ৪টি বেডে ভাগাভাগি করে থাকতে হয় ৮ জনকে। সিনিয়রিটির ভিত্তিতে সিঙ্গেল সিট পাওয়ার সুযোগ যেন স্বপ্নের মতো।

বাকি দুটি ভবনের মধ্যে অনার্স বিল্ডিং আর মিড বিল্ডিং একদম একই। কিন্তু অনার্স বিল্ডিংয়ে এক রুমে দুজন, আর মিড বিল্ডিংয়ে একেকটি রুমে ৬ জনের করে বরাদ্দ।
অনার্স বিল্ডিংয়ে সাধারণত যাদের সিজিপিএ সবচেয়ে ভালো, তাদেরকেই সিট দেওয়া হয় যাতে তারা নিরিবিলি পরিবেশে পড়াশোনার সুযোগ পান। তবে শুধু সিজিপিএ দিয়েই সিট পাওয়া যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ ও কঠিন। তাই আবারো রেফারেন্সের দ্বারস্থ হতে হয়।
এ তো গেল প্রথম বর্ষে হলের সিঙ্গেল খাটে ডাবলিং করবার প্রক্রিয়া। যখন জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বৈধভাবে সিঙ্গেল সিট পাওয়ার প্রসঙ্গ আসে, তখন আবার শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি।
তবু সিঙ্গেল সিটের ব্যাপারে একেক হলে একেক নিয়ম। সুফিয়া কামাল হলে মাস্টার্সের আগে সিঙ্গেল সিট পাওয়ার সুযোগ নেই। অন্যদিকে রোকেয়া, কুয়েত মৈত্রী ও শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে চতুর্থ বর্ষেই সিঙ্গেল সিট পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
হলের প্রতিটি রুমে দুইজন করে সিনিয়র সিঙ্গেল সিট পেতে পারেন। তবে একই রুমে যদি একই বর্ষের তিনজন থাকেন, তাহলে তাকে সিঙ্গেল সিট পেতে হলে রুম বদল করতে হয়।
শুধু হল প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়ে সিটের আশায় বসে থাকলে, সেই সিট পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীকে নিজ উদ্যোগে সিট খুঁজে এনে সেশন ম্যাম এবং ফ্লোর ম্যামকে জানাতে হয়।
এরপরও সেই সিট তাকে দেওয়া হবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। তাই আবারো রেফারেন্সের মাধ্যমে সিটের ব্যবস্থা করতে হয়।
যেখানে এই ধরণের সিট সংকট, সিট নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, সেখানে কিছু শিক্ষার্থী আবার ক্ষমতা খাটিয়ে প্রথম বর্ষ থেকেই সিঙ্গেল সিট পেয়ে যান। আর হল প্রশাসন সব জেনেও চোখে ঠুলি পড়ে বসে থাকে।
এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে গেলে নিজের মাথার ওপরে ছাদটুকু হারাবার ভয় থাকে। তাই অধিকাংশ শিক্ষার্থী তা নীরবে মেনে নেন।
তাছাড়া অভিযোগের প্রক্রিয়াও তো সহজ নয়। কমপক্ষে সাত দিন ঘোরাঘুরির পর অভিযোগ হয়তো সঠিক জায়গায় পৌঁছাবে। এরপরও তা তদন্তসাপেক্ষ।
তদন্ত সম্পন্ন হতে হতে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার সিটের মেয়াদই শেষ হয়ে যাবে। কেননা, আর যাই হোক — এসব তো সময়সাপেক্ষ বটেই।
এদিকে, হল ছাড়ার নোটিশ পেয়েছেন ২০১৬-১৭ সেশনের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী অপর্ণা বিশ্বাস। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ কিংবা আগস্টের প্রথম এক সপ্তাহের মধ্যে তাকে হলের সিট ফাঁকা করতে হবে।
হলের সিট কাটানো যেন আরেকটি মহাকাব্য! হল অফিস থেকে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং, রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে জনতা ব্যাংক, জনতা ব্যাংক থেকে হল অফিস — এইভাবে চক্রাকারে ঘুরতেই থাকে।
একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর পক্ষে বিভিন্ন অফিস-ব্যাংক ঘুরে টাকা জমা, রসিদ সংগ্রহ করা — এক দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমন শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় নিয়েও কোনো নিয়ম পরিবর্তন করে না, নিয়োগ দেয় না কোনো স্বেচ্ছাসেবক।
অনেক জুনিয়রদের অনুরোধ করে একেকজনকে সঙ্গে নিয়ে একেক অফিসে গিয়েছেন অপর্ণা। তবুও এখনো সিট কাটানোর আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে পারেননি। আরও কিছু ফরমালিটিজ বাকি আছে।
তিনি জানান, "সিট না কাটলে সার্টিফিকেট তোলা যায় না। এদিকে সিট কাটানোর কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে কোনো ধরণের সাহায্য পাইনি। সামান্য সহানুভূতিটুকুও দেখায় না। সত্যি বলতে আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের কথা কেউ ভাবে না।"
এই হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত্ব। প্রশাসন আর যাই করুক, বৈষম্য কিন্তু করে না! তাই একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে যে নিয়ম, একজন প্রতিবন্ধী কিংবা অসুস্থ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও ঠিক একই নিয়ম নির্ধারণ করে দেয়।
স্নাতক (সম্মান) ও অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা মাস্টার্স শিক্ষার্থী মিলিয়ে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজারের কাছাকাছি। এরমধ্যে স্নাতকসহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করছেন এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫ হাজার। বাকিরা নৈশকালীন ও বিভিন্ন স্বল্পকালীন কোর্সের শিক্ষার্থী।

যারা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক কোর্সে ভর্তি হন, মূলত তারাই সুযোগ পান আবাসিক হলে থাকার। তবে সেক্ষেত্রেও যেসব এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস যাতায়াত করে (যেমন নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর) এবং যাদের স্কুল-কলেজ ঢাকায় ছিল, তাদেরকে সিট পাওয়ার অযোগ্য বিবেচনা করা হয়।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব হল রয়েছে, তাতে ১৬ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা আছে। ফলে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকতে হয়। অনেকেই দ্বৈত আবাসিক হিসেবে প্রচণ্ড কষ্ট করে হলে থাকেন।
এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশার সঙ্গে। তিনি বলেন, "আমরা সার্বিক বিষয়ে বিভিন্ন কমিটি গঠন করেছি। একটা সমগ্র ব্যবস্থা, নিয়মকানুন এক-দু'দিনে চাইলেই বদলে ফেলা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছি। সংস্কার সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এগুলো সম্পন্ন করতে হয়তো সময় লাগবে। তবে যখন এসব বিষয়ে ফল দেখতে পাবেন, তখন সবকিছু আপনারাই বুঝতে পারবেন।"
"নারীদের হলের সংখ্যা কম হওয়ায় তাদের সিট সংকট তুলনামূলক বেশি। তাই যেসব শিক্ষার্থী আবাসিক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না, তাদেরকে মাসে তিন হাজার টাকা করে আবাসন ভাতা দেওয়া হচ্ছে।"
"নতুন নারী হল নির্মাণের ব্যাপারেও কথাবার্তা চলছে। আশা করছি, ততদিন আমরা ধৈর্য ধরতে পারব," বলেন তিনি।
যদিও 'জুলাই আন্দোলনের' পর রাজনৈতিক ক্ষমতা খাটিয়ে সিট পাওয়ার রেওয়াজ অনেকটাই কমেছে, তবে সিস্টেম কি আদৌ বদলেছে?
নাকি এখনো সেই 'লাঞ্চের পরে আসেন', 'এখন না, পরে আসেন', 'আজ নয়, কাল' — এই টালবাহানা চলছেই?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ছেলেদের জন্য ১৪টি আবাসিক হল রয়েছে, সেখানে মেয়েদের হলের সংখ্যা মাত্র পাঁচটি।
'জুলাই আন্দোলনে' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল। ছাত্রলীগের হাতে মার খেয়ে নাক দিয়ে রক্ত ঝরানো সেই নারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের শক্ত ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
পুলিশ-প্রশাসনের বিরোধিতা সত্ত্বেও তালা ভেঙে, অন্ধকার রাতের বেড়াজাল টপকে, অবরোধবাসিনীরা নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। প্রতিরোধের অস্ত্র হিসেবে পুঁজি করেছিলেন সমস্ত জীবনের জমিয়ে রাখা সাহসকে।
কিন্তু আন্দোলনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্য কি একটুও কমেছে? হলে সিট বরাদ্দ পাওয়া নিয়ে নানান ভোগান্তির পাশাপাশি এ প্রশ্ন তো থেকেই যায়।