মস্তিষ্কপ্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে চীন, মাস্কের নিউরালিংকের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে

বেইজিংয়ের একটি সরকারি হাসপাতালে কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠল চীনা অক্ষরে লেখা বাক্য—'আমি খেতে চাই'। বাক্যটি এসেছে ৬৭ বছর বয়সী এক নারীর চিন্তা থেকে, যিনি অ্যামিওট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস (এএলএস)—বা লু গেরিগ রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়েছেন।
চলতি বছরের মার্চে বেইজিং রেডিও ও টেলিভিশন স্টেশনের ধারণ করা ভিডিওতে ধরা পড়ে এই ঘটনা। এটি ছিল একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অংশ, যেখানে পাঁচজন রোগীর মস্তিষ্কে 'বেইনাও-১' নামের কয়েন-আকারের একটি চিপ স্থাপন করা হয়। এটি একটি তারবিহীন 'ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস' (বিসিআই)—এমন একটি প্রযুক্তি, যা আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতিতে পরিচিতি পেয়েছিল। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এক্ষেত্রে চীন দ্রুত তাদেরকে ছুঁয়ে ফেলছে।
চীনা ইনস্টিটিউট ফর ব্রেইন রিসার্চের (সিআইবিআর) পরিচালক ও এই ট্রায়ালের প্রধান বৈজ্ঞানিক লুয়ো মিনমিন জানান, বিসিআই প্রযুক্তির চাহিদা এখন 'অনেক শক্তিশালী', এবং সম্ভাব্য রোগীদের কাছ থেকে তারা 'অভাবনীয়' অনুরোধ পাচ্ছেন।
লুয়ো সিএনএনকে দেওয়া এক বিরল সাক্ষাৎকারে বলেন, 'রোগীরা বলছেন, এটি অনেক ভালো লাগছে। যেন তারা নিজ শরীরের পেশির ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছেন।'
তিনি আরও জানান, মস্তিষ্ক থেকে আসা সংকেত বিশ্লেষণ করে পাঠ্য রূপে বা যন্ত্রচালিত গতিবিধিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিটি 'উচ্চমাত্রার নির্ভুলতা' দেখাচ্ছে। আগামী এক বছরে আরও ৫০ থেকে ১০০ রোগীর মস্তিষ্কে এই চিপ স্থাপন করে ট্রায়ালের গতি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
তিনি বলেন, 'আমরা চাই এই প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে যাক। যদি এটি নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হয়… তবে বিশ্বব্যাপী ক্লিনিক্যাল ব্যবহার সম্ভব হবে।'
চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত চীনের 'বেইনাও-১' প্রকল্পে মোট ৫ জন রোগীর মস্তিষ্কে চিপ স্থাপন করা হয়েছে—যেটি ইলন মাস্কের নিউরালিংকের সংখ্যার সমান। আরেক মার্কিন কোম্পানি 'সিনক্রোন', যার পেছনে বিনিয়োগ করেছেন জেফ বেজোস ও বিল গেটস, তারা এখন পর্যন্ত ১০ জন রোগীর ওপর পরীক্ষা চালিয়েছে—এর মধ্যে ৬ জন যুক্তরাষ্ট্রে এবং ৪ জন অস্ট্রেলিয়ায়।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক ম্যাক্সিমিলিয়ান রিজেনহুবার, যিনি বেইনাও প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত নন, তিনি সিএনএনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পরে শুরু করলেও চীন দ্রুত অগ্রগতি দেখাচ্ছে।
তিনি বলেন, 'চীন শুধু ধরে ফেলছে না, বরং এখন অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা করছে এবং কিছু ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতেও শুরু করেছে। এটি খুবই উৎসাহজনক, কারণ দুই দেশেই এখন ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে—তারা বুঝতে পারছে বিসিআই প্রযুক্তির বিশাল সম্ভাবনা।'
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'প্রিসিডেন্স রিসার্চ'-এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর মস্তিষ্কপ্রযুক্তি খাতের বাজার ছিল প্রায় ২৬০ কোটি ডলারের। ২০৩৪ সালের মধ্যে তা বেড়ে ১ হাজার ২৪০ কোটি ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র, উভয়ের জন্যই এটি শুধু অর্থ আয়ের বিষয় নয়।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বহুদিন ধরেই চীনকে বিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চাচ্ছেন। গত মার্চে রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমে তিনি লেখেন, প্রযুক্তিখাত এখন 'বিশ্ব প্রতিযোগিতার মুখ্য ময়দান ও অগ্রভাগ'। তার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা যুক্তরাষ্ট্রে উদ্বেগ তৈরি করেছে, যার ফলে প্রযুক্তি খাতে, বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে টানাপড়েন চলছে।
ভিন্ন পথে চীনের অগ্রগতি
২০১৮ সালে বেইজিং পৌর সরকার ও কয়েকটি স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে চীনা ইনস্টিটিউট ফর ব্রেইন রিসার্চ (সিআইবিআর) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর দুই বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর কাছে ইলন মাস্ক গড়ে তুলেছিলেন নিউরালিংক।
২০২৩ সালে সিআইবিআর 'নিউসাইবার নিউরোটেক' নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। এই প্রতিষ্ঠানটি ব্রেইন টেকনোলজির পণ্য, বিশেষ করে 'বেইনাও-১' নিয়ে কাজ করছে। নিউসাইবারের প্রধান বিজ্ঞানী লুয়ো সিএনএনকে গত মে মাসে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ঢোকার সুযোগ দেন।
লুয়ো বলেন, এএলএস রোগে আক্রান্ত ষাটের কাছাকাছি বয়সী এক নারী দীর্ঘদিন ধরে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছিলেন না।
ওই নারী সম্পর্কে তিনি বলেন, 'তিনি সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন, জানতেন তিনি কী চান, কিন্তু মুখে বলতে পারতেন না। চিপ বসানোর পর তিনি এখন সহজ বাক্য অনেকটাই সঠিকভাবে বলার মতো সক্ষম হয়েছেন।'
তবে সব ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস গবেষণাতেই একটি বড় বিষয় হলো ঝুঁকি ও কার্যকারিতার ভারসাম্য রক্ষা করা।
রিজেনহুবার জানান, অধিকাংশ আমেরিকান প্রতিষ্ঠান চিপ বসাতে আরও গভীর পদ্ধতি ব্যবহার করে, যেখানে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র ঢেকে রাখা বাইরের আবরণ 'ডুরা ম্যাটার'-এর ভেতরে চিপ স্থাপন করা হয়, যাতে ভালো সংকেত ধরা যায়। তবে এতে জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়ে।

তিনি বলেন, 'দেখে ভালো লাগছে যে, নিউসাইবার সম্ভবত ডুরা ম্যাটার ভেদ না করেও যথেষ্ট সংকেত পাচ্ছে, যাতে নির্দিষ্ট শব্দ ডিকোড করা সম্ভব হচ্ছে।'
এএলএস রোগীর ওপর চলতি বছরের মার্চে শুরু হওয়া পরীক্ষাটি ছিল মানুষের ওপর বেইনাও-১ চিপের তৃতীয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এগুলোই ছিল বিশ্বের প্রথম 'সেমি-ইনভেসিভ' বা তুলনামূলক কম আক্রমণাত্মকভাবে মানব মস্তিষ্কে তারবিহীন বিসিআই স্থাপনের প্রাথমিক ধাপ—এমনটাই দাবি করেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। মে মাস পর্যন্ত আরও দুটি ট্রায়াল শেষ হয়েছে, মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচটিতে।
স্পষ্ট লক্ষ্য
ভূরাজনৈতিক টানাপড়েন বেড়ে চলায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির তুলনা এখন নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস' (বিসিআই) প্রযুক্তির সূচনা হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে।
এর কয়েক দশক পর, ২০১৩ সালে ওবামা প্রশাসন 'ব্রেইন ইনিশিয়েটিভ' নামে একটি প্রকল্প চালু করে। মার্কিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি স্নায়ুবিজ্ঞানের প্রযুক্তি প্রকল্পে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক সংস্থা 'সিনক্রোন' ২০২১ সালের জুলাইয়ে মানবদেহে প্রথম বিসিআই ট্রায়াল শুরু করে। তিন বছর পর, ইউসি ডেভিস হেলথ-এর এক প্রকল্প এএলএস রোগীর মস্তিষ্কের সংকেতকে বাক্যে রূপান্তর করে, ৯৭ শতাংশ নির্ভুলতায়—যা তাদের মতে এ ধরনের প্রযুক্তির মধ্যে সবচেয়ে নিখুঁত ফলাফল।
ওই বছরই ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠানও প্রথম মানবদেহে চিপ স্থাপন করে পরীক্ষামূলকভাবে কম্পিউটারের মাউস নিয়ন্ত্রণে সফল হয়।
চীন মস্তিষ্কপ্রযুক্তির পথে নামে অনেক পরে, ১৯৯০-এর দশকে। কিন্তু অগ্রগতির গতি বেশ দ্রুত। চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো একটি জাতীয় ব্রেইন প্রকল্প চালুর প্রস্তাব দেয় দেশটির বিজ্ঞানীরা। এরপর ২০১৬ সালে দেশের 'ফাইভ ইয়ার প্ল্যান'-এ (পাঁচ বছরের পরিকল্পনা) এই প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা চীনের অগ্রাধিকারের তালিকা নির্ধারণ করে।

২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চীনের একটি শীর্ষ স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রে কর্মরত লিলি লিন বলেন, 'চীনে ব্রেইন সায়েন্স এখনও নতুন। শুরুতে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও উন্নয়নের গতি অন্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। সরকার প্রচুর তহবিল দিয়েছে এবং প্রতিবছর তা বাড়ছে।'
গত বছর চীন সরকার এই খাতে গবেষণার জন্য প্রথমবারের মতো নীতিগত নির্দেশনা প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি বেইজিং, সাংহাইসহ বড় শহরের স্থানীয় সরকারগুলো গবেষণা, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও বাণিজ্যিকীকরণে মস্তিষ্কপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেনহুবারসহ কয়েকজন গবেষক ২০২৪ সালে চীনের ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই) প্রযুক্তি নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করেন। সেখানে বলা হয়, চীনা গবেষকদের কাজ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে 'জটিলতায় তুলনীয়'।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, 'আমরা দেখেছি, চীনের নন-ইনভেসিভ (অস্ত্রোপচার ছাড়া) বিসিআই গবেষণা অন্যান্য বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত দেশের সমপর্যায়ের। তারা আরও নির্ভুলতা, দ্রুত তথ্য প্রবাহ এবং বিস্তৃত ব্যবহারের পথে বাধা কাটিয়ে উঠতে কাজ করছে। চীনের ইনভেসিভ (অস্ত্রোপচারভিত্তিক) গবেষণা অতীতে পিছিয়ে থাকলেও এখন গতি পেয়েছে এবং ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাচ্ছে।'
লুয়ো, যিনি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে—দুই দেশেই কাজ করেছেন, বলেন, ব্রেইন টেকনোলজিতে এখনও যুক্তরাষ্ট্রই 'সবচেয়ে এগিয়ে'। তবে চীনের 'বেইনাও-১' ও ইলন মাস্কের 'নিউরালিংক' এক নয়—তুলনা করলে 'আপেল আর কমলার' মতো আলাদা।
দুই প্রযুক্তির মধ্যে পার্থক্য শুধু চিপ বসানোর জায়গায় নয়—মস্তিষ্কের কোন অংশের সিগন্যাল (সংকেত) নেওয়া হচ্ছে, কীভাবে ডেটা পাঠানো হচ্ছে—সেটাও আলাদা। চীনা চিপটি মস্তিষ্কের বেশি অংশ থেকে সংকেত নেয়, তবে প্রতিটি নিউরনের তথ্য কিছুটা কম নির্ভুল।
লুয়ো বলেন, 'সব মিলিয়ে আমি মনে করি না যে এই দুটি পণ্য একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী বা একে অপরকে বাদ দিয়ে তৈরি। এখনই বলা যাচ্ছে না, ভবিষ্যতে কোন পথে রোগীরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন।'