চীনে গুঁড়িয়ে ফেলার হুমকি উপেক্ষা করে বানালেন ঝুঁকিপূর্ণ ১১তলা কাঠের বাড়ি, এখন পর্যটনকেন্দ্র

দেখতে কিছুটা ক্যাম্পিংয়ের তাঁবুর মতো, আবার কিছুটা বিশাল এক বিয়ের কেকের মতো। মাঠের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত, এগারো তলা কাঠামো।
টাওয়ারসদৃশ এই কাঠামোটির গাঢ় লাল রঙের ছোট ছোট কাঠের ঘরগুলো একে অন্যের ওপর ভারসাম্য বজায় রেখে সাজানো। যত উপরের দিকে ওঠে, ততই সেগুলোর আকার ছোট হয়ে আসে। মাথা থেকে নিচে নেমে আসা তারের জালের মতো গাঁথুনিতে যেন গোটা কাঠামোটিকে একসাথে বেঁধে রাখা হয়েছে।
ভেতরের চেহারাও তেমন গোছানো নয়। পুরোনো বিদ্যুৎ খুঁটি দিয়ে ছাদের ভার সামলানো হয়েছে, আর নীচু বিম থেকে ঝুলছে বৈদ্যুতিক তার ও পাওয়ার স্ট্রিপ। কাঠামোর ভারসাম্য রক্ষায় কোথাও কোথাও রাখা আছে পানি ভর্তি বড় বড় পাত্র।
এক তলা থেকে আরেক তলায় উঠতে হয় হাতে বানানো খাড়া সিঁড়ি বেয়ে, যেগুলোর পাশে নেই কোনো হাতল। তাই পা ফেলতে হয় খুব সতর্ক হয়ে।
এই টাওয়ারের নকশাকার, নির্মাতা এবং বাসিন্দা—সবই একাই চেন তিয়ানমিং। ৪৩ বছর বয়সী এই চীনা ব্যক্তি সুরক্ষা বা আরাম নিয়ে বিশেষ ভাবেন না। সাবলীল ভঙ্গিতে তিনি উঠে যান পাঁচ তলার পাঠকক্ষ কিংবা ছয়তলার খোলা ছাদে চা খাওয়ার জায়গায়।

নবম তলায় দাঁড়িয়ে দূরের দিকে তাকান চেন। চোখে পড়ে সারি সারি একরকমের পাকা অ্যাপার্টমেন্ট—সেখানেই থাকেন তার সাবেক প্রতিবেশীরা। আর তিনি একা, দাঁড়িয়ে আছেন নিজের তৈরি দুলতে থাকা কাঠের রাজপ্রাসাদে।
'লোকজন বলে, এই বাড়িটা নাকি জীর্ণ–একটু বাতাসেই উড়ে যাবে,' হাসতে হাসতেই বলছিলেন চেন তিয়ানমিং। বাড়িতে ঢুকলে অবশ্য কথাটা খুব একটা অসম্ভবও মনে হয়নি।
'কিন্তু এর একটা সুবিধা আছে,' তিনি যোগ করলেন, 'এটা চোখে পড়ে। মানুষ প্রশংসা করে। অন্যরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে, তবু কেউ তাদের বাড়ির দিকে তাকায় না।'
চেনের এই কাঠের বাড়িটি এতটাই অদ্ভুত আর ব্যতিক্রম যে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের গুইঝৌ প্রদেশের গ্রামীণ প্রান্তে এর টানেই ছুটে আসে কৌতূহলী দর্শক আর পর্যটকেরা।
অনেকেই বলছেন, এ যেন হ্যারি পটারের 'দ্য বোরো', বা ডক্টর সুসের ছবির পাতা থেকে উঠে আসা কোনো কল্পনার কাঠামো। কেউ কেউ তো একে তুলনা করেছেন হায়াও মিয়াজাকির হাউল'স মুভিং ক্যাসল-এর সঙ্গেও।

চেন তিয়ানমিংয়ের কাছে এই কাঠের টাওয়ার কেবল একটি বাড়ি নয়—তিনি যেভাবে তিনি থাকতে চান, ঠিক সেভাবেই বেছে নেওয়া এক জীবন। স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশ, প্রতিবেশীদের কটাক্ষ কিংবা সাধারণ বাস্তববোধ—কোনো কিছুর প্রতিই তার তোয়াক্কা নেই।
২০১৮ সালে তিনি এই টাওয়ারের কাজ শুরু করেন, যখন গুইঝৌর শিংই শহরের প্রশাসন তাদের গ্রামে একটি রিসোর্ট তৈরির পরিকল্পনা নেয়। তখন চেনের পরিবার যে বাড়িটিতে থাকত, সেটি তার কৃষক বাবা-মা আশির দশকে নিজেদের হাতে গড়ে তুলেছিলেন। সরকারি ক্ষতিপূরণের অঙ্ক তাদের কাছে একেবারে অপ্রতুল মনে হওয়ায়, তারা ঘর ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান।
কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের বাড়ির গাছ কেটে ফেলা শুরু হলে, চেন দেরি করেননি। হাংজৌ শহরে প্যাকেজ কুরিয়ারের চাকরি করছিলেন তখন—সব ফেলে তড়িঘড়ি করে ফিরে এলেন গ্রামের বাড়িতে। ওই দিন থেকেই শুরু তার প্রতিরোধ।

ভাই চেন তিয়ানলিয়াংকে সঙ্গে নিয়ে চেন তিয়ানমিং প্রথমে বাড়ির তৃতীয় তলা যোগ করার কাজ শুরু করেন। তারা গিয়ে হাজির হন একটি পুরনো বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল মার্কেটে। সেখান থেকে কিনে আনেন পুরানো বিদ্যুৎ খুঁটি আর লাল রঙের কম্পোজিট বোর্ড—যা কালো বোর্ডের তুলনায় সস্তা।
এরপর হাতুড়ি, পেরেক আর স্ক্রু দিয়ে সেই উপকরণগুলোকে রূপ দিতে থাকেন মেঝে, দেয়াল আর স্তম্ভে। ঘর তৈরি হচ্ছিল একেবারে নিজেদের হাতে।
এরপর চেন তিয়ানমিং, যিনি অনেক দিন ধরেই স্থাপত্যের প্রতি অপেশাদার আগ্রহ পোষণ করতেন, ভাবতে শুরু করেন—চতুর্থ তলা যোগ করলে কেমন হয়? যদিও ভাই ও বাবা-মা বলেছিলেন, তার দরকার নেই। কিন্তু চেন থেমে থাকেননি। একা একাই তৈরি করে ফেলেন চতুর্থ তলা। তারপর আসে পঞ্চম, তারপর ষষ্ঠ।

'হঠাৎ করেই মনে হলো নিজেকে একটু চ্যালেঞ্জ করি,' বলছিলেন চেন। 'আর যখনই কোনো একটা ছোট লক্ষ্য বা স্বপ্ন পূরণ করি, তখন সেটা অনেক অর্থবহ মনে হয়।'
তার এই তাড়নার পেছনে কাজ করছিল ক্ষোভও—প্রশাসনের প্রতি। বারবার ভাঙার নির্দেশ, বাড়িতে এসে চাপ সৃষ্টি—চেনের পরিবার এসবের মধ্যেই ছিল সবসময়। তখন অবধি গোটা এলাকায় কেবল তাদের বাড়িটিই টিকে আছে; বাকিরা সবাই প্রায় তিন মাইল দূরের নতুন অ্যাপার্টমেন্টে চলে গেছেন। (চীনা গণমাধ্যমকে স্থানীয় কর্মকর্তারা এখনো বলে আসছেন, এই কাঠামো 'অবৈধ'।)
চীনের আধুনিকায়নের অভিযানে গত কয়েক দশক ধরে, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে গৃহ ও জমি অধিগ্রহণ বেশ সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা শেষ অবধি নিজেদের ঘর আঁকড়ে ধরে রাখেন, তাদের বাড়িকে কখনও কখনও বলা হয় 'নেইল হাউস'—যেন পুরো এলাকা গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরও এক কোণে পেরেকের মতো টিকে আছে তারা।
তবু, খুব কম 'নেইল হাউস'ই চেন তিয়ানমিংয়ের বাড়ির মতো চোখে পড়ে।
চেন একসময় গণিতে স্নাতক করছিলেন, কিন্তু মাঝপথে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন—কারণ, তার মনে হয়েছিল উচ্চশিক্ষা মূল্যহীন। এরপর বহু বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন শহর থেকে শহরে—কখনও ক্যালিগ্রাফির সেলসম্যান, কখনও ইনস্যুরেন্স এজেন্ট, কখনও কুরিয়ার হিসেবেও কাজ করেছেন। তবুও, মনের ভেতর সব সময় কাজ করেছে গ্রামের জীবনের প্রতি একটা টান।

২০১৮ সালে যখন বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে গ্রামে ফিরে আসেন, তখনই সিদ্ধান্ত নেন—আর শহরে ফিরবেন না। থেকে যাবেন এখানেই, নিজের ভূমিতে।
'আমি চাই না আমার বাড়িটা একদিন শহর হয়ে উঠুক,' বলছিলেন চেন, নিজের ক্ষেতে চাষ করা সবজি দিয়ে মা'র হাতে রান্না করা নুডলস খেতে খেতে। 'আমি যেন এই গ্রামের একজন পাহারাদার।'
গত কয়েক বছরে তার বাড়ি ভেঙে ফেলার হুমকিও কম আসেনি। চেন তিয়ানমিং স্থানীয় প্রশাসন ও নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন, যা এখনও বিচারাধীন।
যদিও প্রস্তাবিত রিসোর্ট প্রকল্পটি স্থানীয় সরকারের অর্থ সংকটের কারণে আটকে পড়েছে।
তবু, চেন নিজের নির্মাণকাজ থামাননি। তার বাড়ি এখন তার আগ্রহ ও শখের এক চলমান প্রদর্শনী।
প্রথম তলায় ঝুলছে হাংজৌয়ের শিল্পীদের লেখা ক্যালিগ্রাফি। পঞ্চম তলায় রয়েছে পুরনো বইয়ের গাদা, বেশিরভাগই ইতিহাস, দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের। ষষ্ঠ তলায় সাজানো আছে বিভিন্ন ধরণের গাছপালা আর দোলনার মতো ছাদের সাথে দড়ির সাহায্যে ঝুলানো একটি কাঠের তক্তা। আট তলায় আছে এক আর্ট স্টুডেন্টের উপহার দেয়া একটি ল্যাম্পশেড।
প্রতি তলা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চেন নিজের শোবার ঘরও উপরের তলায় সরিয়ে নেন। 'এটাই তো মজার,' তিনি বলেন। (তার বাবা-মা ও ভাই মূলত নিচতলায় ঘুমান এবং খুব কমই এই ঝুঁকিপূর্ণ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠেন।)

প্রতিদিন সকালেই তিনি উপরে থেকে নিচ পর্যন্ত পুরো বাড়িটা পরিদর্শন করেন। চার ও পাঁচ তলার মজবুতির জন্য জানালার মধ্য দিয়ে দড়ির সাহায্যে কাঠের খুঁটি তুলে নিয়ে যান।
একবার ঝড়ে পাঁচ তলার এক দেয়াল ভেঙে পড়ার পর, তিনি বাড়ির বিভিন্ন স্থানে পানি ভরে বড় বড় বালতি রাখেন ভারসাম্য রক্ষার জন্য। শেষমেশ নিচের তলাগুলোর বেশিরভাগ দেয়ালই ভেঙে ফেলেন, যাতে বাতাস বাড়ির ভিতর দিয়ে সোজা প্রবাহিত হতে পারে।
'বাড়ির বিন্যাসের এক নিয়ম আছে, যা বলছে—যদি আমি এই বাড়ির যত্ন না নিই, তাহলে এটি সর্বোচ্চ দুই বছরের মধ্যেই ধসে পড়বে,' বলেন চেন তিয়ানমিং। তিনি আরও যোগ করেন, 'কিন্তু যতক্ষণ আমি টিকে আছি, বাড়িটাও টিকে থাকবে।'
মেরামতের জন্য তার আনুমানিক ২০ হাজার ডলারের বেশি খরচ হয়েছিল নির্মাণ সামগ্রীতে, আর আইনজীবীর খরচ হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ডলার।
চেনের পরিবার যদিও তার অদ্ভুত ইচ্ছেগুলো নিয়ে উচ্ছ্বসিত নয়, অন্তত সম্মত হয়েছেন। প্রতি সপ্তাহান্তে তারা বেশ কিছু কৌতূহলী দর্শকের আসা-যাওয়া নিয়ে অভ্যস্ত।
যদিও স্থানীয় প্রশাসন বাড়িটির পাশে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়ে একটি সাইনবোর্ডও বসিয়েছে।