মাইলস্টোনে আহত ছোট বোনকে একাই ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এল কলেজপড়ুয়া রোহান

বিকেল তিনটার একটু আগে মেট্রোরেলে ওঠার সময় এক নারীকে ফোনে কান্নাকাটি করতে দেখলাম। বুঝতে সময় লাগল না, উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনায় তার মেয়ে আহত হয়েছেন।
ইয়াসমিন (৪০) নামের সেই নারীটি বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন কত দূর?' তার মেয়ে, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ইউশা তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। সেদিকেই যাচ্ছেন তিনি।
বারবার প্রার্থনায় হাত তুলে বলছিলেন ইয়াসমিন, 'ইউশা আজ স্কুলে যেতে চাইছিল না। কেন ওকে জোর করলাম, হায় আল্লাহ! তুমি আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দাও, ওকে কিছু কইরো না।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে পৌঁছাতে যেন অনেক সময় লেগে যাচ্ছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ইয়াসমিনের সঙ্গেই যাব। যেন মনে হচ্ছিল, ইউশার কিছু হলে আমি তা মেনে নিতে পারব না। কিংবা আমি না গেলে সে সুস্থ হবে না—এমনই এক অদ্ভুত টান অনুভব করছিলাম।
স্টেশন থেকে নেমে ইয়াসমিন অটোরিকশা নিলেন, আমি উঠলাম প্যাডেল রিকশায়। কিছুক্ষণ পরেই তাকে হারিয়ে ফেললাম।
তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে তাকে আবার খুঁজে পেলাম। ইউশাকে খুঁজতে তিনি এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। পরে কিছু স্বজনের সঙ্গে তার দেখা হলো। হাসপাতালের কর্মীরা জানালেন, মাইলস্টোন স্কুলের কেবল দুজন আহত শিক্ষার্থীকে এখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, বাকিদের জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে।
আমরা সেখানেই রওনা দিলাম। ভিড় ঠেলে, সাংবাদিক আর স্বজনদের পাশ কাটিয়ে পাঁচতলায় পৌঁছালাম। ইউশাকে সেখানেই পাঠানো হয়েছিল।
সেখানে কর্মকর্তারা এবং স্বেচ্ছাসেবকরা সমন্বিতভাবে অ্যাম্বুলেন্স, ট্রলির চলাচল নির্বিঘ্ন করতে প্রবেশপথ খালি রাখছিলেন।
ইয়াসমিন ওয়ার্ডে ঢুকে গেলেন। চিকিৎসক ও নার্সদের কাজের সুবিধার্থে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
ওয়ার্ডের বাইরেও অনেক অভিভাবক ছিলেন, তাঁদের সন্তানরা চিকিৎসাধীন। কেউ কেউ বেঁচে নেই, কিন্তু চিকিৎসকেরা তখনও তা স্বজনদের জানাননি।
একজন চিকিৎসক জানালেন, ইউশার শরীরের ৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। তিনি এটাকে গুরুতর বলে মনে করছেন না। কারণ, অনেকের তুলনায় এটি বেশ কম।
ওয়ার্ডের বাইরে আরও এক মা, নির্জন, অপেক্ষা করছিলেন তার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে নিলয়ের (১২) জন্য। পাশে দুজন বাবা কান্না করছিলেন; কেমন আছে তাদের সন্তানেরা, জানেন না।
বিকেল চারটার দিকে ইউশার বড় ভাই রোহানের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি মাইলস্টোন কলেজেরই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
রোহান বললেন, 'আমার বোন তেমন খেলাধুলা করে না। কিন্তু যেখানে বিমানটি পড়ল, ঠিক সেখানেই ওর ক্লাস ছিল। আমি দৌঁড়ে গিয়ে ওকে খুঁজতে থাকলাম। পরে দেখি, ওর দুই হাত আর মুখ থেকে রক্ত পড়ছে।'
পরে রোহান ইউশাকে এক ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখান থেকে রেফার করে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। ভাগ্য ভালো, ক্লিনিকেই একটা অ্যাম্বুলেন্স ছিল, ওই অ্যাম্বুলেন্সেই দুই ভাইবোন হাসপাতালে আসেন।
আমি অপেক্ষা করছিলাম। কিছুক্ষণ পর ইয়াসমিন বাইরে এলেন, ছেলের সঙ্গে দেখা হলো তার। তখনো চোখে কান্না।
সাহসী রোহান মাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিল, 'ইউশার বেশি কিছু হয়নি মা, ভয়ের কিছু নেই।'
রোহান বলছিল, সে নিজের চোখে দেখেছে অনেক শিশুর হাত-পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, ইউশা বেঁচে গেছে, এটা অনেক বড় সৌভাগ্য।
কিন্তু সবাই ততটা ভাগ্যবান ছিল না।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে। আহত বহু মানুষ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে এখনও চিকিৎসাধীন।