যেভাবে মিয়ানমারের সংকটে চীনের সুবিধা ও প্রভাব বাড়ছে

চলতি বছরের মার্চে মিয়ানমারে ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রাণ হারান ৩ হাজার ৭৪০ জন। তবে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগই দেশটির প্রধান সংকট নয়। ২০২১ সালে এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর থেকে মিয়ানমারে প্রায় ১০ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ৩০ লাখ মানুষ এবং ২০ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি।
দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে পড়েছে পাঁচ ভাগের একভাগে, যা অভ্যুত্থান-পূর্ব সম্ভাবনার অর্ধেক মাত্র। এসব মিলিয়ে মিয়ানমার এখন এশিয়ার এক অরাজকতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বেআইনি মাদক উৎপাদন, মানব পাচার ও প্রতারণা চক্র সেখানে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের প্রতি উল্লেখযোগ্য মনোযোগ দেয়নি। পশ্চিমা দেশগুলো অভ্যুত্থানের আগের এক দশকে দেশটির গণতান্ত্রিক উত্তরণে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল। কিন্তু তারা এখন ইউক্রেন ও গাজা সংকটে বেশি ব্যস্ত।
তবে চীন সেই শূন্যতা পূরণে পিছিয়ে ছিল না। সীমান্তঘেঁষা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চীন তার ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাপিয়ে গেছে। সামরিক জান্তা ও বিরোধী উভয় পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক রেখে দেশটিতে চীন তার বহুমাত্রিক স্বার্থ রক্ষা করছে। যেমন, সীমান্ত ও ভারত মহাসাগরমুখী বাণিজ্যপথে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, চীনা বিনিয়োগ ও নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং সর্বোপরি, পশ্চিমা প্রভাব হ্রাস করা।
এই কৌশল অত্যন্ত কার্যকর হয়েছে। শুরুতে জান্তা ও প্রতিরোধ গোষ্ঠী—দুই পক্ষই চীনের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান ছিল। কিন্তু এখন কেউই শক্তিধর এই প্রতিবেশীর বিরোধিতা করার সাহস দেখায় না। অস্ত্র ও অবৈধ পণ্যের বাণিজ্যে চীনের দখল তাকে নির্ধারক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এই চিত্র সবচেয়ে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় চীনা বিনিয়োগে নির্মিত একটি প্রকল্প থেকে। মিয়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০ কিমি দীর্ঘ তেল ও গ্যাস পাইপলাইনটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল পেরিয়ে গেছে। কিন্তু উভয় পক্ষই একে রক্ষায় সতর্ক থাকায় একবারও এই পাইপলাইন আক্রান্ত হয়নি।
জান্তাবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে নানান উৎস থেকে আগত যোদ্ধারা। সামরিক হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া তরুণ-তরুণীরা পালিয়ে গিয়ে পাহাড়ি সীমান্তে আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা কয়েক দশক ধরে সরকারবিরোধী সংগ্রামে লিপ্ত জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহীদের কাছ থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পায়।
এই নতুন যোদ্ধাদের অনেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জনগোষ্ঠীর সদস্য। পরে তারা ফিরে গিয়ে দেশের মধ্যাঞ্চলের খরাপ্রবণ 'ড্রাই জোন' এলাকায় জান্তার ওপর হামলা চালানোর পাশাপাশি নিজস্ব স্কুল ও চিকিৎসাকেন্দ্র পরিচালনা করছে। এর প্রতিক্রিয়ায় জান্তা বিমান হামলা ও তল্লাশি অভিযান চালায়।
এই বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়িয়েছে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের মধ্যে একটি অংশ, বিশেষত যারা ভারতের ও থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী এলাকায় সক্রিয়, তারা দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমঘেঁষা এবং 'স্প্রিং রেভোলিউশন' নামে পরিচিত সামরিকবিরোধী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাদের হামলায় জান্তার নিয়ন্ত্রণ থেকে অনেক এলাকা মুক্ত হয়েছে।
অন্যদিকে, চীনা সীমান্তবর্তী প্রায় সব জাতিগত গোষ্ঠীর সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অনেকেই ১৯৮৯ সালে বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল। তারা পশ্চিমা মূল্যবোধ বা গণতন্ত্রে ততটা আগ্রহী নয়।
চীনঘনিষ্ঠ এসব জাতিগত গোষ্ঠী শুরুতে সংঘাতে অংশ না নিলেও, পশ্চিমমুখী গোষ্ঠীগুলো দ্রুত বিপ্লবের প্রতি সমর্থন জানায়—যদিও তাদের অগ্রগতি ছিল ধীর। চীনের ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলো তখন সামরিক জান্তার সঙ্গে অস্ত্রবিরতির মধ্যে ছিল।
কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবরে, 'থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স' নামে পরিচিত চীনপন্থী একটি জোট শান রাজ্যে জান্তার ঘাঁটিতে আকস্মিক হামলা চালায়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তারা রাখাইন রাজ্যেও একই কৌশলে হামলা চালায়। মাত্র দুই মাসে তারা সেনাবাহিনীকে একাধিক পরাজয় দেয়—যা স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালের ঘটনাপ্রবাহকেও ছাড়িয়ে যায়।
ধারণা করা হয়, এই আক্রমণের পেছনে ছিল চীনের সম্মতি। যার মূল লক্ষ্য ছিল চীনা নাগরিকদের পাচার ও প্রতারণায় জড়িত কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করা। লক্ষ্য পূরণ হলে, চীন দ্রুত উভয় পক্ষকে অস্ত্রবিরতিতে নিয়ে আসে।
তবে ২০২৪ সালের জুনে এই জোট সেই অস্ত্রবিরতি ভেঙে দেয়। তাদের একটি গোষ্ঠী শান রাজ্যের লাশিও শহর এবং সেখানে অবস্থিত জান্তার ইস্টার্ন অপারেশনস কমান্ড দখলে নেয়। এর আগে কখনো কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী এত বড় শহর বা সামরিক ঘাঁটি দখল করতে পারেনি। জোটের আরেক অংশ মান্দালয়ের দিকে অগ্রসর হয়ে পাহাড়ি স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে যায়, যেখানে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ একাডেমি অবস্থিত।
এরকম দ্রুত অগ্রগতিতে সেনাবাহিনী ভেঙে পড়তে পারে—এই আশঙ্কায় চীন জোটের সঙ্গে সব বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়, বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ কেটে দেয় এবং গোষ্ঠীর এক নেতাকে অপহরণ করে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও জোটকে পিছু হটতে হয়। আক্রমণ থেমে যায় এবং ২০২৫ সালের এপ্রিলে লাশিও শহর সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এর ফলে মান্দালেতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়।
চীনের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো—মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থীরা ক্ষমতায় এলে দেশটি পশ্চিমা প্রভাবের ঘাঁটিতে পরিণত হবে। তাই চীন এমন গোষ্ঠীগুলোকে প্রভাবিত করছে, যাদের দৃষ্টিভঙ্গি তার কাছাকাছি। যারা চীনের সম্মতি ছাড়া গণতন্ত্রপন্থীদের প্রশিক্ষণ বা অস্ত্র সরবরাহ করে, তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। সরবরাহ লাইন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চীন একদিকে গণতন্ত্রপন্থীদের ক্ষমতা সীমিত রাখছে, অন্যদিকে তাদের ওপর নিজের প্রভাব ধরে রাখছে।
চীনের এই চাপ হয়তো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা মোকাবিলা করতে পারত—যদি অন্য কেউ মানবিক সহায়তা নিয়ে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসত। কিন্তু গত চার বছরে পশ্চিমা সহায়তা চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। গণতন্ত্রপন্থীদের অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে কোনো গঠনমূলক আলোচনা হয়নি। অথচ মানবিক সহায়তা আইনি ও রাজনৈতিকভাবে সহজ, এবং এসব সামাজিকভাবে সক্রিয় গোষ্ঠীর কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে পারত।
তা সত্ত্বেও এই সহায়তা ছিল খুবই অপ্রতুল। ২০২৪ সালে জাতিসংঘের ১ বিলিয়ন ডলারের তহবিলের মাত্র ৩৯ শতাংশ সংগ্রহ সম্ভব হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস কিছুটা চাপের মুখে ১২১ মিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত সহায়তা অনুমোদন করেছে। কিন্তু চীনের সঙ্গে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় সহায়তা না বাড়িয়ে, বরং ট্রাম্প প্রশাসন ইউএসএআইডি বন্ধ করে পরিস্থিতিকে আরও সংকুচিত করেছে।
তাহলে চীন আসলে কী চায়? গত এক বছরে চীনা কূটনীতিকরা জান্তার প্রধান মিন অং হ্লাইংকে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য চাপ দিয়ে আসছেন। তাদের আশা, তিনি নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট হবেন, সামরিক পোশাক ত্যাগ করবেন এবং সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এমন কারো হাতে তুলে দেবেন, যিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটবেন।
কিন্তু জান্তার অধীনে অস্ত্রবিরতির বাইরের কোনো নির্বাচন নিছক প্রহসন ছাড়া কিছুই হবে না। চীনের প্রভাব যতই প্রবল হোক, তারা মিন অং হ্লাইংকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে পারবে না। বরং সম্ভাবনাটা বেশি এই যে—চীন মিয়ানমারে একধরনের 'হিমায়িত সংঘাত' বজায় রাখতে চায়, যাতে সব পক্ষের ওপর তার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ থাকে।
এ বিষয়ে অন্য কিছু উদ্যোগও বিবেচনায় এসেছে। থাইল্যান্ড ও ভারত জান্তাকে সমর্থন করেছে এবং অন্যান্য দেশকে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে উৎসাহিত করছে। সাবেক থাই প্রধানমন্ত্রী ও ধনকুবের থাকসিন সিনাওয়াত্রা জান্তাপ্রধানকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন, এমনকি তাকে ব্যাংককের বিলাসবহুল এক হোটেলে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে এই সমর্থকেরা জান্তার যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থান এবং আগের তুলনায় জনমনে আরও তীব্র ক্ষোভের বাস্তবতা উপেক্ষা করছেন।
সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক উদ্যোগটি আসে ২০২৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার কাছ থেকে। সে বছর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেত্নো মারসুদি চারটি পক্ষ—জান্তা, গণতন্ত্রপন্থী প্রতিরোধ, এবং চীনঘেঁষা ও পশ্চিমমুখী জাতিগত গোষ্ঠীগুলোকে জাকার্তায় 'প্রক্সিমিটি টকস' নামে একটি প্রক্রিয়ায় আমন্ত্রণ জানান। প্রত্যেক পক্ষ ছিল আলাদা হোটেলে, আর ইন্দোনেশীয় কূটনীতিকেরা বার্তা আদান-প্রদানে মধ্যস্থতা করতেন।
সেসময় কোনো পক্ষই মূল ইস্যুতে আলোচনার জন্য প্রস্তুত ছিল না—এবং এখনো হয়তো তা নয়। কিন্তু যদি মিয়ানমারের যুদ্ধের অবসান কোনো আলোচনার টেবিলে হয়, তবে এই প্রক্রিয়াই হতে পারে একটি কার্যকর কাঠামো।