আল জাজিরার বিশ্লেষণ: ভারত, রাশিয়া ও চীনের বাণিজ্য কতটা বড়

চীনের তিয়ানজিনে চলতি সপ্তাহে অনুষ্ঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন ২০টিরও বেশি অ-পশ্চিমা দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান। সোমবার শেষ হওয়া এ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গ্লোবাল সাউথকে কেন্দ্র করে একটি নতুন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়াস নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শি সম্মেলনে উপস্থিত বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বলেন, "আমাদের অবশ্যই আধিপত্যবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে এবং প্রকৃত বহুপাক্ষিকতার চর্চা করতে হবে।"
এসসিও সম্মেলনে ভারত ও রাশিয়াসহ শক্তিশালী উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর নেতারা একত্রিত হন। চীনসহ এসব দেশ বিশ্বের মোট জিডিপিতে এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি অবদান রাখে।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির (ওইসি) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে চীন–ভারত–রাশিয়ার ত্রিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪৫২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালের ৩৫১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। গত বছরজুড়ে এই বাণিজ্য আরও বেড়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটেই শি জিনপিং নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলছেন। তবে সুস্পষ্টভাবেই সেখানে নেতৃত্বের আসনে থাকবে বেইজিং।
এসসিও, যেটিকে অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প ক্ষমতার কাঠামো হিসেবে দেখে থাকেন, বর্তমানে ১০ সদস্যবিশিষ্ট। এতে রয়েছে মধ্য এশিয়ার বড় অংশ, রাশিয়া, চীন, ভারত, ইরান, পাকিস্তান ও বেলারুশ। এই ব্লক বিশ্বের প্রায় ৪৩ শতাংশ জনসংখ্যা এবং ২৩ শতাংশ বৈশ্বিক জিডিপির প্রতিনিধিত্ব করে।
ওয়াশিংটনের প্রতি অসন্তোষ বাড়তে থাকায় বেইজিংয়ের বহুপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ার এ উদ্যোগ এখন আরও জোরালো হয়েছে। বিশেষত মার্কিন বাণিজ্য নীতিমালাই এসসিও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে।
কোন দেশগুলো চীনের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি কেনে?
চীনের রপ্তানির বাজার অত্যন্ত বহুমুখী।
২০২৩ সালে চীনের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যারা প্রায় ৪৪২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এটি চীনের মোট রপ্তানির ১২.৯ শতাংশ। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রনিকস, যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্য এবং টেলিযোগাযোগ সরঞ্জাম।
আঞ্চলিকভাবে এশিয়াই চীনের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য। গত বছর এশিয়ায় চীনের রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১.৬ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য। কেবল ভারতই নিয়েছে ১২০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা চীনের মোট রপ্তানির ৩.১ শতাংশ।
অন্যদিকে ইউরোপে চীন ৮১৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে প্রধান গন্তব্য জার্মানি (১৫১ বিলিয়ন ডলার), রাশিয়া (১১০ বিলিয়ন ডলার) ও যুক্তরাজ্য (৯৫.৩ বিলিয়ন ডলার)।
ভারতের রপ্তানি বৃহৎ রপ্তানি বাজারগুলো
ভারতের রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র।
২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে ৮১.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা ভারতের মোট রপ্তানির ১৭.৯ শতাংশ। এসব পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল ওষুধ বা ফার্মাসিউটিক্যালস, এরপর রয়েছে মূল্যবান পাথর, যন্ত্রপাতি ও টেক্সটাইল।
আঞ্চলিকভাবে এশিয়াই ভারতের রপ্তানির প্রধান বাজার। এ অঞ্চলে ভারত ১৭৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য, যেখানে গেছে ৩১.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য (মোট রপ্তানির ৬.৯%)। এসব পণ্যের বড় অংশই ছিল গহনা ও পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম।
ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার নেদারল্যান্ডস, যেখানে গেছে ২২.৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত ছিল পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম, যার মূল্য প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। চীন ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানি বাজার এবং এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম।
গত ৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্য আমদানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ভারত অব্যাহতভাবে রাশিয়ার থেকে ছাড় পাওয়া মূল্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল কিনছে। এভাবে মস্কোর যুদ্ধে অর্থায়ন করেই চলেছে নয়াদিল্লি।
এর জবাবে ভারত কঠোর অসন্তোষ প্রকাশ করে এই শুল্ককে "অন্যায়, অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য" বলে অভিহিত করে। একইসঙ্গে ভারত তাদের জ্বালানি নীতি স্বাধীনভাবে নির্ধারণের সার্বভৌম অধিকার পুনর্ব্যক্ত করে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ থাকা সত্ত্বেও, মস্কোর দেওয়া উল্লেখযোগ্য ছাড়ের কারণে ভারত রাশিয়ার তেল আমদানি অব্যাহত রেখেছে। একইসঙ্গে ঝুঁকেছে চীনের দিকে। তারই অংশ হিসেবে এসসিও সম্মেলনেও অংশ নেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
রাশিয়ার রপ্তানি সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে যেসব দেশে
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ার রপ্তানি বাজার ছিল অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটি (ওইসি)–এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে চীন ছিল রাশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার, যা রাশিয়ার মোট রপ্তানির ১৪.৬ শতাংশ বা ৭২.১ বিলিয়ন ডলারের সমান। দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার ছিল নেদারল্যান্ডস (৮ শতাংশ বা ৩৯.৫ বিলিয়ন ডলার), এরপর ছিল যুক্তরাষ্ট্র (৫.৫ শতাংশ বা ২৭.৩ বিলিয়ন ডলার)।
কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা দেশগুলোর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার এসব বাজারে প্রবেশাধিকার ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়।
২০২৩ সালে এসে চীন একাই রাশিয়ার রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ (১২৯ বিলিয়ন ডলার) কিনেছে। এরপর ভারত কিনেছে ১৬.৮ শতাংশ (৬৬.১ বিলিয়ন ডলার) এবং তুরস্ক ৭.৯ শতাংশ (৩১ বিলিয়ন ডলার)। অর্থাৎ, এখন রাশিয়ার তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি রপ্তানি এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোতে যাচ্ছে। যার বড় অংশই হলো জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যশস্য, সার ও শিল্পের কাঁচামাল।
চীন-রাশিয়া বাণিজ্য
২০২৩ সালে চীন রাশিয়ায় ১১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যার বড় অংশই ছিল যন্ত্রপাতি ও পরিবহন খাতের সামগ্রী। এর মধ্যে গাড়ি ছিল শীর্ষ রপ্তানি পণ্য।
অন্যদিকে একই বছরে রাশিয়া চীনে ১২৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে, যার প্রধান ছিল খনিজ সম্পদ—বিশেষ করে অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস।
জ্বালানি খাতে ভর করেই চীনের সাথে রাশিয়ার বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত বহাল রয়েছে, জ্বালানি খাতই মস্কোর রপ্তানির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ।
ভারত-রাশিয়া বাণিজ্য
ভারত রাশিয়ার সঙ্গে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতিতে রয়েছে।
২০২৩ সালে রাশিয়া ভারতকে ৬৬.১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে, যার প্রায় ৮৮ শতাংশ ছিল জ্বালানি—প্রধানত অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। এর বড় অংশ ভারত ডিসকাউন্ট বা ছাড়কৃত মূল্যে কিনছে।
অন্যদিকে, ভারতে থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৪.১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাত ছিল কেমিক্যাল, যন্ত্রপাতি ও ধাতু।
ভারত-চীন বাণিজ্য
ভারতের সঙ্গে চীনেরও বড় বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।
২০২৩ সালে চীন ভারতকে ১২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে, যার মধ্যে যন্ত্রপাতি ও কেমিক্যাল পণ্য প্রধান। অপরদিকে ভারত চীনে মাত্র ১৮.১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যেখানে তেল ও জ্বালানি-সংশ্লিষ্ট পণ্যই ছিল সবচেয়ে বড় অংশ।