চীনের সামরিক কুচকাওয়াজে যেভাবে ট্রাম্পের উচ্চঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্য নীতির বিপদ স্পষ্ট হচ্ছে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাজধানী বেইজিংয়ে আয়োজিত এক কুচকাওয়াজে মহাসমারোহে নিজের সামরিক শক্তির প্রদর্শনী করেছে চীন। খবর বিবিসি'র।
হাজার হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির হোয়াইট হাউসে বসে তা নজরে রাখছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, 'তারা আশা করছিল আমি যেন দেখি, আর আমি দেখেছি।'
তিয়েনআনমেন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত বিশাল এই কুচকাওয়াজ নিয়ে বিশেষ কিছু বলেননি ট্রাম্প। শুধু এটুকুই বলেছেন, এটি ছিল 'খুবই, খুবই মনোমুগ্ধকর'। তবে চীনের বার্তা ট্রাম্প ও বিশ্বের কাছে স্পষ্টভাবেই পৌঁছেছে।
বিশ্বে একটি নতুন ও ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার কেন্দ্র এবং গত শতাব্দীর আমেরিকা-সমর্থিত ব্যবস্থার একটি নতুন বিকল্প তৈরি হচ্ছে।
বুধবার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ক্যারোল নাভরোস্কির সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প আবার এ প্রসঙ্গ তোলেন। কিন্তু সেখানেও বিশেষ কিছু নিয়ে আলাপ করেননি।
চীনে গত কয়েক দিনে যা ঘটেছে, তা নিয়ে ট্রাম্পের ধারাবাহিক মন্তব্যে একসঙ্গে মিশে ছিল অনিশ্চয়তা, ক্ষোভ ও উদ্বেগ।
মঙ্গলবার এক পডকাস্ট সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প তিয়েনআনমেন স্কয়ারের কুচকাওয়াজ নিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেন, তিনি চীনের এ শক্তি প্রদর্শনীতে 'কোনো উদ্বেগ' দেখছেন না। ওই কুচকাওয়াজে উপস্থিত ছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনসহ দুই ডজনের বেশি রাষ্ট্রপ্রধান।
তবে মঙ্গলবার রাতেই ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবদানের জন্য চীন কোনো কৃতিত্ব দিচ্ছে না। সেখানে তিনি লেখেন, 'ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং উনকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন, যখন আপনারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।'
ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুললেও, ট্রাম্প আসলে কুচকাওয়াজ ও সামরিক শক্তি প্রদর্শন পছন্দ করেন। গত মাসে তিনি আলাস্কায় পুতিনকে স্বাগত জানান স্টেলথ বোমারু বিমানের প্রদর্শনী ও যুদ্ধবিমানের মহরায় সাজানো লাল গালিচা অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে তিনি ফ্রান্সের বাস্তিল দিবসের কুচকাওয়াজে যোগ দিয়েছিলেন আনন্দের সঙ্গে। এমনকি দুই মাস আগে ওয়াশিংটনে মার্কিন সেনাবাহিনীর ২৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নিজেই এক সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করেন।
তবে বেইজিংয়ের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আর নিখুঁত পদযাত্রার প্রদর্শনীর তুলনায় ট্রাম্পের কুচকাওয়াজ ছিল অনেক সরল। সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ট্যাংক আর বিপ্লবী আমলের সেনারা হোয়াইট হাউসের কাছে কনস্টিটিউশন অ্যাভিনিউ ধরে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে যান।
সব মিলিয়ে এটি ছিল এক নস্টালজিক আয়োজন—ট্রাম্পের 'মেক আমেরিকাকে গ্রেট এগেইন' [আমেরিকাকে আবার মহান করো] স্লোগান ও তার ১৯শ শতকের বাণিজ্যনীতিনির্ভর ভাবনার সঙ্গে মানানসই, যে সময়কে তিনি প্রায়ই আমেরিকার শ্রেষ্ঠ সময় বলেন।
চীনের কুচকাওয়াজে আধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শনের পাশাপাশি ইতিহাস নিয়ে বার্তাও ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পরাজিত করতে নিজেদের বড় ভূমিকা দেখাতে চাইছে কমিউনিস্ট সরকার। যে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে 'আমেরিকান শতক' শুরু হয়েছিল, সেই যুদ্ধে নিজেদের অবদান তুলে ধরে এখন হয়তো চীন চাইছে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব নিজের হাতে নিতে।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ভেটেরানস অ্যাফেয়ার্সের সচিবের দায়িত্বে থাকা রিচার্ড উইলকি বলেন, 'এটা হলো নিয়ম নতুন করে লেখার প্রথম পদক্ষেপ। আর সেটা শুরু হয় ইতিহাস নতুন করে লেখার মাধ্যমে।'
তিনি আরও বলেন, জাপানের বিরুদ্ধে এশিয়ায় বিজয়ে চীনের জাতীয়তাবাদী বাহিনী ও মার্কিন সেনাদের ভূমিকা ছিল অনেক বড়। কমিউনিস্ট সেনাদের ভূমিকা ছিল অনেক সীমিত।
তবে এ সপ্তাহে চীন থেকে ভেসে আসা উদ্বেগজনক দৃশ্য কেবল এই কুচকাওয়াজেই সীমাবদ্ধ নয়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী মার্কিন নীতিনির্ধারকরা অন্য ঘটনাগুলোতেও চিন্তিত হতে পারেন।
সোমবার তিয়েনজিনে এক অর্থনৈতিক শীর্ষ সম্মেলনে শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির পুতিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করেন। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, চীন ও ভারতের শীতল সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হতে শুরু করেছে। এর প্রধান কারণ ট্রাম্পের শুল্কনীতি, যা দুই দেশকেই বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'আমেরিকা ফার্স্ট' [সবার আগে অ্যামেরিকা] নীতি বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ককে অগোছালো করে দিয়েছে। তিয়েনজিনে চীন, রাশিয়া ও ভারতের নেতাদের মধ্যে যে নতুন সম্পর্ক দেখা দিয়েছে, তা দেখিয়েছে কৌশলগত দিক থেকে বিশ্বের বড় কয়েকটি দেশ কিভাবে একত্রিত হতে পারে—যা চ্যালেঞ্জিং হলেও পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত নয়।
ট্রাম্প শুল্ককে তার পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করেন, যা আমেরিকান শিল্পকে রক্ষা করবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য নতুন রাজস্ব তৈরি করবে। যদি এতে কোনো কূটনৈতিক মূল্য দিতে হয়, তা আপাতত তিনি দিতে রাজি বলে মনে হচ্ছে না।
ট্রাম্প-সংশ্লিষ্ট আমেরিকা ফার্স্ট ফরেন পলিসি ইনস্টিটিউটের আমেরিকান সিকিউরিটির কো-চেয়ার উইলকি বলেন, 'কোরিয়ান, জাপানি, ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনামীরা জানে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে অস্থিরতা কোনো আসল হুমকি নয়। হুমকি হচ্ছে, চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি।'
ট্রাম্প দূরদেশের সংঘাত বা সমস্যার দিকে খুব মনোযোগ দেন না। তার মূল দৃষ্টি থাকে আমেরিকার চারপাশের 'প্রভাব বলয়'-এর ওপর—যার মধ্যে গ্রীনল্যান্ড, পানামা এবং কানাডা অন্যতম।
তবে ট্রাম্পের জন্য বিপদ হলো, তার ব্যাপক বাণিজ্য নীতিগুলো হয়তো শুধু ঝুঁকি নিয়ে আসবে, কোনো লাভ নয়। ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, সম্প্রতি তৈরি হওয়া আমেরিকাকেন্দ্রিক বাণিজ্য ব্যবস্থা শিগগিরই মার্কিন আদালত বাতিল করতে পারেন।
শুক্রবার মার্কিন এক আপিল আদালত রায় দিয়েছেন, ট্রাম্পের অনেক শুল্ক ফেডারেল আইনের ভুল ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে আরোপিত হয়েছে। ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, তিনি বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যাবেন। আদালতের রক্ষণশীল বিচারকরা প্রায়ই তার পক্ষে রায় দিলেও, তারা এমন প্রেসিডেন্টকে সমর্থন করেন না যারা কংগ্রেসের স্পষ্ট অনুমতি ছাড়া বড় নীতি প্রণয়ন করেন। তাই ট্রাম্পের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার উদার ব্যাখ্যা আদালত সমর্থন করবে, তা নিশ্চিত নয়।
বাণিজ্য নিয়ে ট্রাম্প নিজস্ব পথে এগিয়েছেন—কয়েক মাসের মধ্যে নতুন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরি করে মার্কিন বাণিজ্যকে এক নতুন পথে চালিত করেছেন।
এটি একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী কৌশল, যা ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্বিতীয় আমেরিকান স্বর্ণযুগের পথে এগিয়ে নেবে। তবে ঝুঁকিগুলো বাস্তব—হোক তা তিয়েনআনমেন স্কয়ারের কুচকাওয়াজ কিংবা মার্কিন আদালতের কক্ষ।
