দেশের বাজারে বিশ্বমানের চায়ের ব্র্যান্ডিংয়ে নতুন সম্ভবনা তৈরি করল হালদা ভ্যালি

চারটি কাজের বয়ামে 'ড্রাগন ওয়েল গ্রিন টি', 'সিলভার নিডল হোয়াইট টি', 'গোল্ডেন আইব্রাউ ব্ল্যাক টি', 'হালদা ভ্যালি ব্ল্যাক টি' পুড়িয়ে তা আবার শক্ত আকর্ষণীয় বাক্সে ঢোকানো হলো। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এসব বিশেষায়িত চা-সম্বলিত বাক্সগুলোকে গিফট বাক্স হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
দেশের অন্যতম চা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান হালদা ভ্যালির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হালদা ভ্যালি ফুড অ্যান্ড বেভারেজ দেশীয় বাজারে এসব বিশ্বমানের চায়ের নতুন সম্ভবনা তৈরিতে কাজ করছে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে চায়ের বাজারে মানসম্মত নতুন নতুন ধরণ যুক্ত করা হচ্ছে। বর্তমানে আট ধরনের বিশেষায়িত চা এবং তিন ধরনের 'সিটিসি ব্ল্যাক টি' বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি।
শুধু তাই নয়, চায়ের বিশেষ ব্র্যান্ডিং করতে ঢাকায় একটি বিশেষায়িত টি-লাউঞ্জও চালু করেছে হালদা ভ্যালি ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। সেখানে প্রায় ৬০ ধরনের চা পাওয়া যায়।
যেভাবে শুরু
২০২৩ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার পরিত্যক্ত চা বাগান হালদা ভ্যালি অধিগ্রহণ করে বাগান চা চাষ শুরু করেন শিল্পপতি নাদের খান। এরপর ২০০৪ সালে খাগড়াছড়ির রামগড় চা বাগান অধিগ্রহণ করে চাষ শুরু করা হয়। এখানে সাধারণ চা নিজস্ব কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। এরপর বিক্রেতারা তা বাজারজাত করে। আন্তর্জাতিক মানের 'ড্রাগন ওয়েল গ্রিন টি' উৎপাদন করে রপ্তানির উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেন নাদের খান।
২০১৬ সালে তার ছেলে চিকিৎসক শামীম খান পৈত্রিক ব্যবসায় যুক্ত হলে সেটি নতুন মাত্রা পায়। তখন দেশের বাজারে বিশ্বমানের 'ড্রাগন ওয়েল গ্রিন টি' বাজারজাত করতে গুরুত্ব দেন তিনি। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যাত্রা শুরু হয় হালদা ভ্যালি ফুড অ্যান্ড বেভারেজের।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ডা. শামীম খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '২০১৪ সাল থেকে চীনের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এনে প্লাকিং ও কারখানার শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ানো হয়েছে। শুরুতে রপ্তানি করাই লক্ষ্য ছিল। দুইবার চীনেও রপ্তানি করা হয়েছিল। দেশের বাজারে ১৬ হাজার বা ৩০ হাজার টাকা কেজি দরের চা বিক্রি করা কঠিন। এই বাজার সৃষ্টির মতো চ্যালেঞ্জ আমি নিয়েছি। শুরুতে আমার বাবাও বিরোধিতা করে বলেছিলেন, এতো দামের চা কেন কিনবে। আমি এই চ্যালেঞ্জ নিয়েছি।'

বাগানের সর্বোৎকৃষ্ট পাতা থেকে তৈরি বিশেষায়িত চা
সাধারণ চা থেকে বিশেষায়িত চায়ের উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত ধাপগুলো আলাদা। মূলত বাগানের উৎকৃষ্ট পাতা থেকে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে বিশেষায়িত চা তৈরি করা হয়। এই চা বাছাইকৃত পাতা থেকে উৎপাদন হয়। আর তুলনামূলক কম পরিমাণে। সাধারণত 'সিটিসি ব্ল্যাক টি' সাত থেকে আট ধাপে কারখানায় প্রক্রিয়াজাতকরণের পর পণ্যে রূপান্তর হয়। এছাড়া স্বাদের ভিন্নতা আনার জন্য কৃত্রিম ফ্লেভার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বিশেষায়িত চায়ের ক্ষেত্রে মাত্র দুই থেকে চারটি ধাপে কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এখানে কোন আর্টিফিশিয়াল উপাদান ব্যবহার করা হয় না। শুধুমাত্র চায়ের কুড়ি ও কচি পাতা দিয়েই এই চা তৈরি হয়। আর বাগানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নির্ধারিত পরিমিত সার ব্যবহার করা হয়। পরিমিত সার ব্যবহারের মাটি, গাছ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়।
ডা. শামীম খান জানান, বিশেষায়িত চায়ের বাগানও আলাদাভাবে করতে হয়। প্রশিক্ষিত প্লাকিং শ্রমিকদের বেতন কাঠামোও আলাদা। খুবই বাছাইকৃত প্লাকিং করা হয়। একজন প্লাকিং শ্রমিক সারা দিনে ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম চায়ের পাতা তুলতে পারে না। যেখানে সাধারণ ব্ল্যাক টি ১০০ কেজিরও তুলে থাকেন। অনুপাত এমন যে, বাগানে বছরে ৯-১০ লাখ ব্ল্যাক টি-এর বিপরীতে গ্রিন টি ও ওয়াইট টি হয় ১০-১২ হাজার কেজি তোলা যায়। বর্তমানে আমাদের দুটি বাগানের বিশেষায়িত চায়ের জন্য দুই শতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন।
বিশেষায়িত চায়ের ব্র্যান্ডিংয়ে নতুন মাত্রা প্যাকেজিং
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে ১৮৫০ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে চায়ের চাষ শুরু করেছিল ব্রিটিশ সরকার। দার্জিলিং, আসাম, শ্রীলঙ্কার মতো স্থানগুলোতে চায়ের যে ব্র্যান্ডিং হয়েছে, বাংলাদেশে তা হয়নি। ভারতের পর্যটন খাতে দার্জিলিং, আসাম ও শ্রীলঙ্কার সিলন টি-এর কদর আছে। কিন্তু বাংলাদেশ পিছিয়ে। অথচ হেরিটেজ হিসেবে বাংলাদেশেও চায়ের ঐতিহ্যবাহী অতীত রয়েছে।
বিষয়গুলো অনুধাবন করে দেশে বিশ্ব মানের চায়ের বাজার তৈরির মতো চ্যালেঞ্জের উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন হালদা ভ্যালি ফুড অ্যান্ড বেভারেজের এমডি শামীম খান। তিনি বলেন, 'চিকিৎসক হিসেবে আমি সবকিছুর গভীরে গিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করি। ব্যবসায়ে যুক্ত হওয়ার পর শিল্পটির গভীর নিয়ে চিন্তা করেছি। আমি যখন সিঙ্গাপুর, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের বিজনেস ট্রিপ দিতাম, তখন চায়ের ব্র্যান্ডিং সম্পর্কে জানতাম। কীভাবে ট্যুরিজমে বা সংস্কৃতিতে ভ্যালু (মূল্য) যুক্ত করছে, তা দেখতাম। বিষয়গুলো নিয়ে স্টাডি করতাম।'
শামীম খান আরও বলেন, সিঙ্গাপুরের ব্র্যান্ড টিডাব্লিউজি বিভিন্ন ধরনের চা সংগ্রহ করে তা পরিবেশন করে থাকে। শুধু ভোক্তাদের ভোগ নয়, লাক্সারি পণ্য হিসেবেও উপস্থাপন করা হচ্ছে। লাইফস্টাইল পণ্য হিসেবে বাজারজাত করা হচ্ছে। চীনের কিছু ব্র্যান্ডও ভালো মার্কেটিং করছে।
তিনি বলেন, 'আমাদের দেশের বড় ব্যবসায়ীরা বা শিল্পপতিরা বিদেশ থেকে চা কিনে আনছেন দামি। তখন আমি প্যাকিং নিয়ে চিন্তা করলাম। চা যে গিফট আইটেম হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, এর প্রচলন আমরা চালু করেছি।'
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, টিনের কন্টেইনার, কাঁচের জারকে বাক্সে উপস্থাপন করা হয়। আবার অনেক সময় কাপও দেওয়া হয়। এমন অন্তত ছয় ধরনের গিফট বাক্স বাজারজাত করা হচ্ছে। ২০২৪ সালে জাতীয় চা দিবসে প্যাকেজিংয়ের জন্য বেস্ট প্যাকেজিং অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল হালদা ভ্যালি ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন অ্যাম্বাসি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গিফট বাক্সটি সংগ্রহ করছে।
টি-লাউঞ্জ
দেশের কফিশপের প্রচলন থাকলেও বিশেষায়িত অভিজাত চা-শপ নেই। চায়ের ব্র্যান্ডিংয়ে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে রাজধানী ঢাকার গুলশানে হালদা ভ্যালি টি-লাউঞ্জ নামে একটি 'ডেডিকেটেড টি-শপ' চালু করা হয়। তবে করোনা মহামারির ধাক্কায় তা পুরোপুরি রেস্তোঁরায় রূপ দেওয়া হয়। তবে রেস্তোরাঁয় চায়ের গুরুত্ব আলাদা। বিশ্বমানের অন্তত ৬০ ধরনের চা এখানে পরিবেশন করা হয়। সকালের নাস্তার সঙ্গে বিশেষায়িত চা বা বিকালের জন্য বিশেষায়িত চা এখানে পরিবেশন করা হয়। ১৭৫ টাকা থেকে শুরু করে ৩৪৫ টাকায় পর্যন্ত প্রতি কাপ চা বিক্রি করা হয়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
প্রতি বছরই নতুন নতুন চায়ের ধরণ যুক্ত করছে হালদা ভ্যালি ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। আরো চারটি ধরণ গবেষণার মাধ্যমে উন্নয়ন পর্যায়ে আছে। চলতি বছরই এগুলো বাজারে আনার পরিকল্পনা আছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রাকৃতিক উপাদানে ভিন্নতা আনা ও স্বাদের ভিন্নতা আনা নিয়ে কাজ করছে চলছে।
শামীম খান বলেন, 'নতুন নতুন চা যুক্ত করার পাশাপাশি বিদেশের বিভিন্ন শহরের ই-কমার্সের মাধ্যমে আমাদের চা সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্যগত সুরক্ষার উপাদান হিসেবে চা যুক্ত করা নিয়েও গবেষণা চলছে। যেহেতু আমি একজন চিকিৎসক, তাই কোন চা মানুষের কোন রোগ প্রতিরোধের উপাদান হিসেবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে কাজ করছি। নতুন বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের ব্র্যান্ডকে প্রতিষ্ঠিত করছি। আমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন দেশে অভিজাত চায়ের বাজার অনেকটা শূন্য ছিল। এখন তবুও একটা অবস্থান আছে।'
২০০৩-০৪ সালে দুটি বাগানের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হওয়া হালদা ভ্যালি প্রায় ২১০০ একর ভূমিতে বছরে প্রায় ১৮ লাখ কেজি উৎপাদন করছে। প্রতিষ্ঠানটির অধীনে মোট ১৮০০ কর্মী আছে।