সংকটে থাকা চা বাগানের সহায়তায় ন্যূনতম নিলামমূল্য বাড়াল চা বোর্ড

দেশের চা শিল্পকে পুনরায় গতিশীল করতে নিলামে চায়ের ন্যূনতম মূল্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। ঈদের পর শুরু হওয়া নিলামে নতুন এই মূল্যহার কার্যকর হবে।
চা পাতার লিকারের (গুণগত মান) ওপর ভিত্তি করে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা থেকে ৮৫ টাকা পর্যন্ত মূল্য বৃদ্ধি করা হবে। চা উৎপাদন বাড়লেও বাগান মালিকদের ধারাবাহিক লোকসানের প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এ ঘোষণার পরপরই খোলাবাজারে চায়ের দাম প্রতি কেজিতে অন্তত ২০ টাকা বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, নিলাম পুনরায় শুরু হলে পাইকারি ও খুচরা বাজারেও চায়ের দাম আরও বাড়তে পারে।
বছরের পর বছর ধরে নিলামে চায়ের দাম কম থাকায় অধিকাংশ চা বাগানই লোকসানে পড়ছিল। এর ফলে দেশের মোট ১৭০টি চা বাগানের মধ্যে অন্তত ৩০টি বন্ধ হয়ে গেছে। এই সংকট বিবেচনায় নিয়ে ২০২৪ সালের ৬ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রথমবারের মতো নিলামে চায়ের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
বাণিজ্য উপদেষ্টার সভাপতিত্বে ১৪ মে চূড়ান্ত হওয়া সংশোধিত মূল্য কাঠামোতে দেশের চা বাগানগুলোর উৎপাদন খরচের গড় হিসাব ধরে নিলাম মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনা হয়েছে। উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে কেজিপ্রতি ২৪৫ টাকা।
চায়ের বর্তমান মূল্য ও করণীয় নির্ধারণে অংশীজনদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকেই সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের চায়ের ন্যূনতম মূল্য কেজিপ্রতি ২৪৫ টাকা এবং উত্তরাঞ্চলের 'বটলিফ' চায়ের ন্যূনতম মূল্য ১৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে মাত্র ২০টি নিলামে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।
শিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশকে দেশে চা খাতের শ্রমিক মজুরি, গ্যাস, সার, বিদ্যুৎ, কয়লাসহ সব ধরনের উৎপাদন উপকরণের দাম বেড়েছে। চা মোড়কজাতকারী কোম্পানিগুলোও ব্র্যান্ডিংসহ বিভিন্ন খরচ বৃদ্ধির কারণে প্যাকেটজাত চায়ের দাম বাড়িয়েছে। টানা কয়েক বছর ধরে চায়ের দরপতন হওয়ায় দেশের অনেক বাগানই ঋণ পরিশোধ, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা প্রদান কিংবা নতুন করে উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে পারছে না। ফলে ন্যায্য দাম নির্ধারণের দাবি আরও জোরালো হয়েছে।
চা উৎপাদক প্রতিষ্ঠান এম এম ইস্পাহানী লিমিটেডের চা বাগান 'নেপচুন'-এর ব্যবস্থাপক কাজী আরফান উল্লাহ সরকারের হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, 'গত তিন বছর চায়ের বাজার খারাপ ছিল। সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে— এটি হলো মৃত্যুশয্যায় থাকা রোগীকে স্যালাইন দেওয়ার শামিল। চায়ের ন্যূনতম মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। এখন দেখার বিষয়, ট্রেডাররা কিনছেন কি না; নাকি উৎপাদিত চা ওয়্যারহাউজে পড়ে থাকে!'
গত বছর সব অঞ্চলের চায়ের ন্যূনতম মূল্য একই ছিল। তবে এবার অঞ্চলভেদে তা পরিবর্তন করা হয়েছে। সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের চা বাগানগুলোর নিলামমূল্য বেড়েছে। তবে উত্তরাঞ্চলের বটলিফ চা কারখানাগুলোর ন্যূনতম মূল্য গত বছরের তুলনায় সামান্য কমেছে।
ব্রোকার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিস্তারিত গ্রেডিংয়ের ওপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট মূল্যবৃদ্ধি নির্ধারিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, ৫-এর মধ্যে ৪ ও ৪+ গ্রেডের চায়ের দাম এখন সিলেট ও চট্টগ্রামে কেজিপ্রতি ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩১৫ টাকা এবং বটলিফ চায়ের জন্য ২৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বনিম্ন গ্রেড ২ রেটিংয়ের চায়ের দাম সিলেট ও চট্টগ্রামে ১৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪৫ টাকা এবং বটলিফ চায়ের জন্য ১৭০ টাকা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য (অর্থ ও বাণিজ্য) ইয়াসমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, 'দেশের বাগানগুলোর উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যেন বিক্রয়মূল্য পাওয়া নিশ্চিত করা যায়, সেজন্য ন্যূনতম মূল্য সংশোধন করা হয়েছে। চা খাতের সবগুলো স্টেকহোল্ডারের সর্বসম্মত মতামতের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।'
তিনি আশা প্রকাশ করেন, নতুন মূল্যস্তরের ফলে চা উৎপাদনকারী বাগানগুলোর সংকট অনেকটাই কমে আসবে।