যে কারণে সমতলে চা উৎপাদন এতো কমে গেছে

পঞ্চগড় সদরের চা চাষী শাহজালাল গত বছর লোকসানের মুখে ১৫ বছর ধরে লালন করা ৭ একর জমির চা বাগান কেটে ফেলেছেন। এখন সেখানে সবজি চাষ করছেন তিনি। শুধু শাহজালাল নন, জেলার অসংখ্য চাষী একইভাবে বাগান কেটে ফেলেছেন। এর প্রভাব পড়েছে চা উৎপাদনেও।
চা বোর্ডের হিসাবে, গত মৌসুমে পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে উৎপাদন কমেছে অন্তত ৩৪ লাখ কেজি চা পাতা। কমছে চাষাবাদযোগ্য জমিও। সংকট নিরসনে এই শিল্পকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রপ্তানিযোগ্য করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সমতলের চা বাগানে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাস প্রুনিং মৌসুম। মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে চা পাতা উৎপাদনের মূল মৌসুম। ২০২৪ সালে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪৩ লাখ ৯০ হাজার ১৫১ কেজি চা। আগের মৌসুমের তুলনায় এটি ৩৫ লাখ ৫৭ হাজার কেজি কম।
পঞ্চগড়ে সমতলে চা চাষ শুরু হয় ২০০০ সালে। ক্ষুদ্র পরিসরে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি এবং পরে কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট প্রথমে এ বাগান গড়ে তোলে। ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট, ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারীতেও বাগান পর্যায়ে চা চাষ শুরু হয়।
বর্তমানে নিবন্ধিত ১০টি ও অনিবন্ধিত ২০টি বড় চা বাগান (২৫ একরের বেশি) আছে। এ ছাড়া ২ হাজার ১৭৪টি নিবন্ধিত ও ৬ হাজার ১৯৭টি অনিবন্ধিত ছোট বাগান (২৫ একরের কম) রয়েছে।
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদনে সিলেটের পরই রয়েছে রংপুর বিভাগ। তবে গত এক বছরে অন্তত এক হাজার একর জমিতে চা চাষ বন্ধ হয়ে গেছে।
কেন পঞ্চগড়ে চা শিল্প
১৯৬৮ সালে পঞ্চগড় সুগারমিল লোকসানে পড়ার পর কৃষকরা বিকল্প খুঁজতে শুরু করেন। আখ চাষে ক্ষতির মুখে পড়ায় অনেকে চায়ের দিকে ঝুঁকেন। দার্জিলিংয়ের খ্যাতিমান চায়ের মতো পঞ্চগড়ের চায়ের মানও ভালো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লোকসান চাষীদের নিরুৎসাহিত করছে।
উৎপাদন কমার কারণ
চা চাষী ও চা বোর্ডের মতে, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, পাতার ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, গাছ কেটে ফেলা, পরিচর্যার ঘাটতি, সেচের অভাব এবং দীর্ঘদিন ধরে পাতার কম দামসহ ইত্যাদি কারণে উৎপাদন কমছে।
পঞ্চগড় সদরের টুনিহাটের চাষী আজহার উল হক জানান, গত চার বছর ধরে ৫ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়ে ২০ একরের বাগান বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। লোকসানের কারণে গত বছর আড়াই একর বাগান কেটে ফেলতে বাধ্য হন। তাঁর মতে, স্থানীয় সিন্ডিকেটের প্রভাব ঠেকাতে না পারলে চাষীরা নিঃস্ব হয়ে যাবেন।

চাষীদের অভিযোগ, একরে এক রাউন্ডে যেখানে আগে ৩ হাজার কেজি পাতা পাওয়া যেত, এবার সেখানে মিলছে দেড় হাজার কেজি। মানও খারাপ হচ্ছে। তবে চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি পাতা ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। আগের চার বছর এই দাম ছিল ১২ থেকে ১৬ টাকা। অথচ ২০১৯ সালেও একই পাতা ২৮ থেকে ৩৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
চাষীরা আরও জানান, কীটনাশক ও শ্রম খরচ বেড়েছে। চা শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকায় সরকারি সার বরাদ্দ নেই। ফলে চাষাবাদের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে চীন প্রবেশ করায় বাংলাদেশের চা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
চা বাগান কেটে সবজিতে ফেরা
চা পাতার কম দাম ও বাজারে চাহিদাহীনতার কারণে বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের চাষী শাহিনুল ইসলাম গত বছর ২৫ বিঘার বাগান কেটে ফেলেন। বর্তমানে তিনি ৩৫ বিঘায় চা করছেন। তার মতে, খরচ বাড়লেও দাম অনিশ্চিত। এ কারণে অনেক চাষী সবজির দিকে ঝুঁকছেন।
সমতলের চা প্রক্রিয়াজাতকরণে লাইসেন্সপ্রাপ্ত অন্তত ৪৮টি কারখানা রয়েছে। এগুলো চাষীদের কাছ থেকে সবুজ পাতা কিনে রেডি টি তৈরি করে নিলামে বিক্রি করে।
চা বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, সবশেষ মৌসুমে দেশে উৎপাদিত হয়েছে ৯ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৩০ কেজি।
চা বোর্ডের অবস্থান
চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আরিফ খান জানান, ২০২৩ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে চাষ বেড়েই চলছিল। কিন্তু পাতার দাম কমে যাওয়ায় চাষীদের আগ্রহ কমে গেছে। ফলে অনেকেই বাগান কেটে ফেলেছেন। এর প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। তবে চলতি মৌসুমে দাম বাড়ায় চাষীরা আবার কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন।