চায়ের পর পঞ্চগড়ের নতুন অর্থকরী ফসল মরিচ, হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের সম্ভাবনা

চায়ের পর পঞ্চগড়ের অন্যতম অর্থকরী ফসল মরিচের আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উত্তরের জেলা বগুড়াকে ছাড়িয়ে মরিচের বাজারে প্রভাব বিস্তারে পঞ্চগড় অনেক এগিয়ে গেছে। জেলায় মরিচের প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য সম্ভাবনা রয়েছে চলতি বছরে।
পঞ্চগড় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) উপপরিচালক আবদুল মতিন বলেন, "এ বছর জেলায় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার শুকনো মরিচ বাণিজ্যের সম্ভাবনা রয়েছে। গত বছর এখানে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার লাল মরিচের বাণিজ্য হয়েছে। মরিচের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবাদও বছর বছর বাড়ছে, যা কৃষকদের আরও বেশি মরিচ চাষে উৎসাহিত করছে।"
ব্যবসায়ী ও চাষীরা বলছেন, শুকনো মরিচের জন্য ক্রমেই বিখ্যাত হয়ে উঠছে পঞ্চগড় জেলা। চা শিল্পের পর মরিচ আবাদেও 'নিরব বিপ্লব' এর সম্ভাবনা দেখছেন অনেকেই।
মরিচ চাষের জন্য উপযুক্ত সময় ধরা হয় ফাল্গুন থেকে চৈত্র মাস, শ্রাবণ থেকে ভাদ্র মাস এবং রবি মৌসুমের জন্য সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসকে। তবে এর মধ্যে ফাল্গুন থেকে চৈত্র মাসের রোপণ করা মরিচ পঞ্চগড়ে বেশি শুকানো হয়।
চাষী ও কৃষি অফিস বলছে, পঞ্চগড় সদর, আটোয়ারী, তেতুলিয়া উপজেলায় ব্যাপক পরিসরে মরিচের আবাদ করা হয়। গ্রীষ্মের শেষে মরিচ উঠিয়ে শুকানোর পর তা সংরক্ষণ করে বিভিন্নভাবে। তবে বড় বড় ব্যবসায়ীরা মরিচ সংরক্ষণ করে হিমাগারে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, পঞ্চগড়ে এবার মরিচের আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ৬৮৭ হেক্টর জমিতে। ২০২৩ সালে মরিচ আবাদ হয়েছিল ৮ হাজার ২৫ হেক্টরে। এবার মরিচ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ২৮০ মেট্রিক টন। হট মাস্টার, বালু ঝড়ি ও বিন্দুসহ সাত জাতের মরিচেজর আবাদ হয়েছে জেলায়। এছাড়া দেশীয় জাতের পাশাপাশি জিরা, মল্লিকা, বাঁশ গাইয়াসহ বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের মরিচ চাষ করা হয়েছে।

জেলার চাষীরা জানান, ৫০ শতক জমিতে মরিচ উৎপাদনে খরচ হয় সাধারণত ৫০,০০০ থেকে ৬০,০০০ টাকা। ওই জমি থেকে শুকনো মরিচ পাওয়া যায় ২০ মণের ওপরে। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন বাজারে শুকনো মরিচ বিক্রি হচ্ছে প্রতিমণ ৪,৫০০ থেকে ৫,৫০০ টাকা দরে। গড়ে ৫,০০০ টাকা মণ মরিচ বিক্রি হলেও কৃষক লাভবান হবেন। এই হিসাবে ৫০ শতক জমিতে এক লাখ টাকার মরিচ উৎপাদন হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন বলেন, "তবে মরিচ শুকানো, সংরক্ষণসহ বিভিন্ন সমস্যা আছে। এই ক্ষেত্রগুলোতে তাদের প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে চাষীরা আরও দক্ষ ও লাভবান হবেন।"
পঞ্চগড় সদরের মরিচ চাষী রফিকুল ইসলাম বলেন, "পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হওয়ায় এবার মরিচের ফলন ভালো হয়নি। দামও কম। অনেক সময় সিন্ডিকেট করে কৃষকদের ঠকান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।"
এর বাইরে আরও একটি সংকটের কথা জানালেন বগুড়ার সংরক্ষণ ব্যবসায়ী নূর আলম। তিনি জানান, মরিচ সাধারণত সংরক্ষণ করা হয় হিমাগারে। এবার দেশে আলুর উৎপাদন ব্যাপক হারে হওয়ায় হিমাগারগুলোতে মরিচ রাখার জায়গা নেই। ফলে দেশে মরিচের বাজার কিছুটা কম। চাষীরাও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ কারণে।
এদিকে প্রায় ৪০ বছর ধরে শুকনো মরিচের ব্যবসা করছেন বগুড়ার খন্দকার ট্রেডার্সের মালিক মুহাম্মাদ শাহাদত হোসেন সাজু। সম্প্রতি তিনি পঞ্চগড়ের আটোয়ারী বাজার থেকে কয়েক কোটি টাকার মরিচ কিনেছেন। এই ব্যবসায়ী জানান, "এক সময় উত্তরাঞ্চলের মধ্যে বগুড়াকে মরিচের রাজধানী বলা হতো। গত ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। বলতে গেলে দেশের অন্যতম মরিচের হাব এখন পঞ্চগড়। এই আটোয়ারী বাজারে প্রতি মৌসুমে কয়েক কোটি টাকার মরিচের বাণিজ্য হয়। দেশের অনেক ব্যবসায়ী এখান থেকে মরিচ কিনে নিয়ে যান।"
এবার মরিচের দাম তুলনামূলক কম উল্লখ করে শাহাদত হোসেন সাজু বলেন, "গত দুই বছর মরিচ সংরক্ষণ করে ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকে বিনিয়োগ করার পুঁজির অর্ধেক ফিরে পাননি। এই কারণে অনেকে মরিচ কিনছেন না। আবার এবার উৎপাদনও কম।"
পঞ্চগড়ের মরিচ স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবারহ হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এখন শুকনো মরিচ কিনতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা ছুটে আসছেন পঞ্চগড়ে। জেলার আটোয়ারি, শালবাহান, জগদল বাজার, ফুটকি বাড়ি বাজার, ঝলোই বাজার, ময়দান দিঘী বাজার ও টুনির হাটসহ বিভিন্ন হাট-বাজার থেকে মরিচ কিনছেন তারা।

আটোয়ারী বাজারের মেসার্স ভাই ভাই ভান্ডারের মালিক ও এলাকার অন্যতম প্রধান মরিচ ব্যবসায়ী মো. আনারুল ইসলাম বলেন, "এই বাজারে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মরিচ কেনাবেচা হয়। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এসে চাষীদের কাছ থেকে মরিচ কেনেন। সিন্ডিকেট করার সুযোগ নেই।"
"তবে এবার শুরু থেকেই মরিচের দাম কিছুটা কম। সংরক্ষণের অভাবে ব্যবসায়ীরা মরিচ কেনার সাহস দেখাচ্ছেন না। হিমাগারের বাইরে বেশিদিন মরিচ সংরক্ষণ করা যায় না," বলেন তিনি।
এই বাজারে মৌসুমী ভান্ডারের মালিক ইসমাইল হোসেন জানান, "গত ১৫ বছর ধরে উত্তরাঞ্চলের মধ্যে পঞ্চগড় মরিচের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। জেলায় এখন হাজারো মরিচ ব্যবসায়ী রয়েছেন। এর সাথে হাজার হাজার মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে। দিন দিন পঞ্চগড়ে মরিচের ব্যবসা বড় হচ্ছে।"
এদিকে চাষীরা বলছেন, মাঝে মাঝে বাজারে মরিচের দাম কমে গেলে লোকসানের শঙ্কা তৈরি হয়। মরিচ শুকানো অনেক পরিশ্রমের কাজ। পঞ্চগড় জেলার মরিচ চাষ এখন একটি সম্ভাবনাময় কৃষি অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। উৎপাদন, বাজার ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রযুক্তির আধুনিকায়ন হলে এই খাত দেশের অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা রাখতে পারে।