মাখন, পেয়ারা পাতা, বাওবাব পাতা...বিশ্বের যত অদ্ভুত চা-এর গল্প

পানি বাদে যদি পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় কিছু থাকে, তবে নিঃসন্দেহে তা চা। জনপ্রিয়তায় এটি পেছনে ফেলেছে কফি ও বিয়ারকেও, যারা যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে। এই বিশ্বজোড়া ভালোবাসার স্বীকৃতিস্বরূপ, জাতিসংঘ ২১ মে-কে ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক চা দিবস হিসেবে।
চা কেবল লিকার আর দুধের সংমিশ্রণ নয় বরং এটি একেক দেশের আতিথেয়তা ও সংস্কৃতির এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ। তিব্বতের হিমশীতল ঠান্ডায় যেমন আছে মাখন ও লবণ মিশ্রিত পো চা, তেমনি ইংল্যান্ডে সকাল শুরু হয় ইংলিশ ব্রেকফাস্ট চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে।বিশ্বের নানা প্রান্তে এই পানীয়টির রূপ আলাদা হলেও এর মূল বার্তাটি এক- আতিথেয়তা এবং উষ্ণতা।
চায়ের উৎপত্তি নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে এখনও একমত নেই। তবে জাতিসংঘের তথ্যমতে, চায়ের গোড়াপত্তন সম্ভবত উত্তর-পূর্ব ভারত, উত্তর মিয়ানমার ও দক্ষিণ-পশ্চিম চীনে। প্রাচীন চীনা সভ্যতায় পাঁচ হাজার বছর আগে থেকেই চা পান করার প্রমাণ পাওয়া যায়। সে হিসেবে, চা নিঃসন্দেহে বিশ্বের প্রাচীনতম পানীয়গুলোর একটি।
বিভিন্ন ভাষায় 'চা' কে যেসব নামে ডাকা হয়
বিভিন্ন ভাষায় 'চা' এর প্রতিশব্দ খুঁজতে গেলে এক ধরণের ভাষাগত মিল চোখে পড়ে। সব ভাষায় চায়ের নাম আসে দুটো মূল শব্দ থেকে: 'চা' (cha) অথবা 'তে' (te)।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে এই পানীয়ের নাম 'চা'-এর সাথে মিলিয়ে ডাকা হয়।
- মান্দারিন/চীনা ভাষায়: 茶 (চা)
- আরবি ভাষায়: شاي (শায়)
- তুর্কি ভাষায়: çay (চায়)
- হিন্দি ভাষায়i: चाय (চায়)
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে সাধারণত চায়ের নাম 'তে' শব্দটি থেকে পাওয়া । যেমন, ইংরেজিতে 'tea' শব্দটি এসেছে চীনের হক্কিয়েন উপভাষার 'তে' শব্দ থেকে। বাণিজ্য কার্যক্রমের বদৌলতেই চীন থেকে এই শব্দ ইউরোপে পৌঁছায়।
- ইংরেজি ভাষায়: tea (টি)
- ফরাসী ভাষায়: thé (থে)
- স্পেনীয় ভাষায়: té (তে)
- জার্মান ভাষায়: tee (তিই)
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি চা উৎপাদন করে কোন দেশ?
চা গাছ সাধারণত ক্রান্তীয় ও উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে ভালো জন্মে। এই পাতার চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
টি অ্যান্ড কফি ট্রেড জার্নাল-এর গ্লোবাল টি রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের মোট চায়ের প্রায় ৪৮ শতাংশ উৎপাদন করে চীন। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত, যার উৎপাদন ২০ শতাংশ।এরপর রয়েছে যথাক্রমে কেনিয়া (৮%),তুরস্ক (৪%) ও শ্রীলঙ্কা (৩%) । বাকি দেশগুলো সম্মিলিতভাবে উৎপাদন করে বিশ্বের প্রায় ১৭ শতাংশ চা।
বিশ্বে প্রতিদিন কত চা পান করা হয়?
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও)-র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী চা পান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৫ মিলিয়ন টনে। এটি আগের বছরগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
এই বছর সবচেয়ে বেশি চা পান করা হয়েছে চীনে যা প্রায় ৩০ লক্ষ টন। এটি বিশ্বের মোট চা পানের ৪৬ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত, যেখানে একই বছরে প্রায় ১১.৬ লক্ষ টন চা পান করা হয়েছে। এটি বিশ্বে মোট চা পানের ১৮ শতাংশ। এরপর রয়েছে তুরস্ক (২.৫ লক্ষ টন), পাকিস্তান (২.৪৭ লক্ষ টন) এবং রাশিয়া (১.৩৩ লক্ষ টন)। ফাও আরও জানিয়েছে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী চা পানের হার ২ শতাংশ বেড়েছে, এবং এই বৃদ্ধি ২০২৩ সালেও অব্যাহত ছিল।
তবে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে চায়ের চাহিদা ধীরে ধীরে কমছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো অন্যান্য পানীয়র সঙ্গে বেড়ে যাওয়া প্রতিযোগিতা আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব।

বিশ্বের কিছু অদ্ভুত ও ব্যতিক্রমী চা
আন্তর্জাতিক চা দিবস উপলক্ষে জেনে নেয়া যাক পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের কিছু অদ্ভুত ও ব্যতিক্রমী চায়ের ব্যাপারে। এগুলোর স্বাদ যেমন অনন্য, প্রস্তুত প্রণালিও তেমনই অভিনব।
মাখন চা (পো চা)
উৎপত্তিস্থল: তিব্বত ও হিমালয় অঞ্চল
মাখন চায়ের নামের মধ্যেই তার অভিনবত্ব লুকিয়ে আছে। গরম ব্ল্যাক টি বা কালো চায়ে মেশানো হয় চমরী গাইয়ের দুধের মাখন ও লবণ। এর ঘনত্ব অনেকটা ঝোলের মতো। এমন এক প্রচলনের ব্যাপারে জানা যায় যেখানে অতিথিকে চায়ের কাপ খালি হওয়া মাত্রই পুনরায় মাখন চা ঢেলে দেওয়া হতে থাকে, যতক্ষণ না থামতে বলা হয়। তবে নিজ থেকেই চায়ের কাপে চা ঢালা বন্ধ করা হলে মনে করা হয় গৃহকর্তা এবার অতিথিকে বিদায় দিতে চাইছেন।

পেঁয়ারা পাতার চা
উৎপত্তিস্থল: ফিলিপাইন, মধ্যবর্তী আমেরিকা ও আফ্রিকা
এই চা তৈরি হয় পেঁয়ারা গাছের পাতার নির্যাস দিয়ে। এর ঘ্রাণ কিছুটা মাটির মতো।ফিলিপাইনের সংস্কৃতিতে এই চা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে ঘরোয়া ওষুধ হিসেবে। পেটব্যথা উপশমে এটি কার্যকরী। আবার ক্ষত পরিষ্কারেও ব্যবহার করা হয় এই চা।

অপরাজিতা ফুলের চা
উৎপত্তিস্থল: থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনাম
এই চায়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর রঙ। নীলচে রঙের জন্য একে অনেকেই 'নীল চা' নামে চেনেন। তবে চমক এখানেই শেষ নয়—চায়ে লেবুর রস মেশালেই এর রঙ বদলে গিয়ে হয়ে যায় বেগুনি।এই চা তৈরি হয় অপরাজিতা ফুলের নীল রঙের পাপড়ি পানিতে ফুটিয়ে। স্বাদে হালকা,ক্যাফেইন মুক্ত আর দেখতে একেবারেই মনকাড়া।.

বাওবাব পাতার চা
উৎপত্তিস্থল: সাহারা মরুভূমির নিকটবর্তী আফ্রিকা
সাহারা মরুভূমির নিকটবর্তী আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বাওবাব পাতার চা দীর্ঘদিন ধরে ভেষজ ও পুষ্টিকর পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অন্য অনেক ভেষজ চায়ের মতো এর স্বাদ সুগন্ধি বা ফলের মতো নয়। বরং এটি মাটির গন্ধযুক্ত এবং খানিকটা তিতা—অনেকটা পালং শাক সেদ্ধ পানির মতো।

কম্বুচা – এটি কি আদৌ চা?
উৎপত্তিস্থল: চীন, জাপান ও কোরিয়া
কম্বুচা এক ধরনের গাঁজন প্রক্রিয়ায় তৈরি পানীয় যাকে চা হিসেবে পান করা হয় । এই চা তৈরি হয় স্কোবি (SCOBY) নামের জেলির মতো একটি উপাদান দিয়ে, যা মূলত ব্যাকটেরিয়া ও ইস্টের এক জাতীয় মিশ্রণ। অনেক কম্বুচা ভক্তই তাদের স্কোবি -কে পোষা প্রাণীর মতো যত্ন করেন, এমনকি নামও রাখেন। আবার আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবদের মাঝে উত্তরাধিকারসূত্রে দিয়েও থাকেন।

অনুবাদ:নাফিসা ইসলাম মেঘা