‘আমি নারী, আমি সব পারি’

আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতা উপন্যাসে সুবর্ণলতার সেই এক চিলতে ঝুল বারান্দা আর খোলা আকাশের আকাঙ্ক্ষার কথা মনে পড়ে? যে খোলা আকাশের অর্ধেক অধিকার ছিনিয়ে নিতে সুবর্ণলতা আর বেগম রোকেয়াদের লড়তে হয়েছে একটা আস্ত জীবন, সেই খোলা আকাশের ঝলমলে রোদ্দুর আজকের সুবর্ণলতারা গায়ে মাখে।
ওঁরা খোলা চুলে দাপিয়ে বেড়ায় পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তজুড়ে, প্রাণখুলে হাসে, গলা চড়িয়ে গান ধরে। এখন 'অসূর্যম্পশ্যা' শব্দখানা অপ্রচলিত, কারো কারো কাছে দুর্বোধ্য আর খানিকটা অবাস্তবও বটে। মহাকাশ থেকে মহাসাগর, রান্নাঘর থেকে কর্পোরেট অফিস, পৌরাহিত্য থেকে বাজারঘাট—নারীর বিচরণ এখন সবখানে। তিনি এখন মহলে বন্দী মহিলা কিংবা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের মেয়েছেলে নন; তিনি এখন নারী, কন্যা, জায়া এবং জননী। তিনি রাঁধেন, চুলও বাঁধেন।
আজকে লিখব বাংলাদেশের এমন সব অপরাজিতাদের গল্প যারা একেকজন লড়াইয়ের ময়দানে ফুটে থাকা অলকনন্দা ফুল। স্বকীয়তা, আত্মবিশ্বাস আর হার না মানার প্রত্যয়ই তাদের সৌন্দর্য আর স্নিগ্ধতা।
নড়াইল জেলার বাহিরগ্রামে যখন ঘর আলো করে জন্মেছিলেন অপর্ণা বিশ্বাস, তখনও পৃথিবীর রঙ সাদাকালো হয়ে যায়নি। মফস্বলের জল-হাওয়ায় একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল ছোট্ট মেয়েটি। বাবা মায়ের আদরযত্ন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা, নতুন নতুন বন্ধু, বিকেল হলেই লুকোচুরি কিংবা কানামাছি খেলা। বেশ চলছিল অপর্ণার জীবন।
অপর্ণা তখন ক্লাস ফোরে। মাঝেমধ্যেই ঝাপসা দেখছিল ক্লাসরুমের বোর্ডে। বাবা-মাকে বললেও অতটা গুরুত্ব দেন নি তারা। এরপর একদিন একেবারেই সবটা অন্ধকার হয়ে গেল। আর দেখতে পেল না অপর্ণা। অন্ধকার গ্রাস করে নিল সেই খেলার মাঠের সবুজ সতেজ ছবিটা। অপর্ণা ভুলে যেতে লাগল হাওয়াই মিঠাইয়ের রঙ, পেয়ারা গাছের মগডালটার চেহারা। অনেক চিকিৎসা, ছোটাছুটির পরও সে দৃষ্টি আর ফেরেনি। অন্ধত্ব বরণ করে নিতে হয়েছিল বছর দশেকের মেয়েটিকে।

অপর্ণা আর কখনই দেখেননি বসন্তের বাগানবিলাসের ফুটে থাকা। কিন্তু তিনি তো থেমে থাকবার মেয়ে নয়। লড়াই করে বেঁচে থাকবার মন্ত্র অপর্ণা শিখে নিয়েছিলেন নিজেই। সাথ দিয়েছিলেন বাবা-মা। তাই তিনি না দেখেও চালিয়ে যেতে থাকেন পড়ালেখা। কিন্তু কী করে তা সম্ভব? গ্রামের ছাপোষা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ব্রেইল স্কুলই বা পাবে কোথায়?
সাধারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শুরু হয় দৃষ্টিযোদ্ধা অপর্ণার লড়াই। দেখতে না পেলেও শুনতে তো পান। তাই শুনে শুনেই পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। মোবাইলে রেকর্ড করে সেখানা শুনে আত্মস্থ করা আর তারপর পরীক্ষার সময় একজন শ্রুতিলেখকের সাহায্যে অংশগ্রহণ...এভাবে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনো।
তার আত্মবিশ্বাস, জ্ঞানপিপাসা, অদম্য ইচ্ছা আর হার না মানার মনোভাব শেষ অব্দি তাকে পৌঁছে দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায়। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে সংস্কৃত বিভাগে ভর্তি হন অপর্ণা। শত বাধা পেরিয়ে সংস্কৃত বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তিনি।
এখন অপর্ণা স্বপ্ন দেখেন একখানা ভালো চাকরির। অপর্ণা মনে করেন, যদি ইচ্ছাশক্তি আর মনের জোর থাকে, তবে অসম্ভবকেও সম্ভব করে তোলা যায়। চোখে না দেখেও মনের চোখ দিয়ে রাঙিয়ে তোলা যায় পৃথিবী।
চলুন এবারে ঘুরে আসা যাক দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্যন্ত জেলা সাতক্ষীরা থেকে। ভোর ৫টায় আলো ফোটার আগে ঘুম ভাঙে সুমিত্রা রানী দাসের। প্রাতকর্ম সেরে উঠোন ঝাড়ু দিয়ে রান্নার কাজ শুরু করতে হয় তারপর। রান্না শেষে কিছু খাবার সাথে বেঁধে নিয়ে সাড়ে ৭টার মধ্যে কাজে বেরিয়ে যেতে হয় সুমিত্রাকে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে।
বৈশাখ মাসের প্রখর রোদে ধান কাটার কাজ কিংবা নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে ইট ভাঙ্গা, বালি তোলা, টাইলস লাগানোর কাজ, কখনো কখনো বাসাবাড়ি ঝাড়ামোছা, দিনচুক্তিতে জঙ্গল পরিষ্কার—এসব কাজই গত ২১ বছর ধরে করেছেন সুমিত্রা। এ কাজ করে তিনি লেখাপড়া শিখিয়েছেন তার মেয়েকে। সারাদিন নিদারুণ পরিশ্রমের কারণে অভাবের সংসারে নুন-ভাত জোটে।
সুমিত্রার বিয়ে হয়েছিল চৌদ্দ বছর বয়সে। বাপের বাড়িতে থাকা অবস্থায় ক্লাস সেভেন অব্দি পড়েছিলেন। তারপর বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ালেখার পাট শেষ করেন।

এক মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে ছিলেন সুমিত্রার পাড়াতুতো বান্ধবী। সে সূত্রে মাস্টারমশাইও স্নেহ করতেন তাকে। এক অদ্ভুত মানসিক শক্তি পেয়েছিলেন তিনি সেই মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে। তাই শ্বশুরবাড়ির অনুশাসন আর স্বামীর চোখ রাঙ্গানিকে এড়িয়ে সন্তানগুলোর মুখে ভাত তুলে দিতে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ছোটো কাজের অজুহাতে বসে থাকেননি হাত গুটিয়ে। যেমনটা করতেন তার মাদকাসক্ত স্বামী।
বর্তমানে দিনমজুর হিসেবে কাজের ক্ষেত্রে এক বেলা (আনুমানিক ৫ ঘণ্টা) ২৫০ টাকা পান সুমীত্রা। আর দিনচুক্তিতে কাজ ধরলে মজুরি মেলে ৪০০ টাকা। সুমিত্রা যখন প্রথম কাজ শুরু করেন, তখন এই হাড়ভাঙা খাটুনিতে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তবু তিনি যে মা। তিনটে সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে তিনি অসম্ভবকে করে তুললেন সম্ভব। হাত ভর্তি ফোস্কা নিয়ে পরদিন আবারো হাজির হতেন ধান কাটতে। একেকদিন ভেবেছেন, সব ছেড়েছুড়ে পালানোর কথা। কিন্তু পারেনি। এরপর আস্তে আস্তে খানিকটা অভ্যেস আর বেশ অনেকখানি দক্ষতা আসে কাজে।
দিনমজুরির কাজ করে সুমিত্রা একবেলা যে মজুরি পান, একই পরিমাণ সময় এবং শ্রম দেওয়া একজন পুরুষ শ্রমিক পান তার থেকে ১০০-১৫০ টাকা বেশি। এ নিয়ে বারেবার কথা বলেছেন সুমিত্রা এবং তার মতন নারী শ্রমিকেরা। কথা বললে কাজ চলে যায়, ছাঁটাই করে দেওয়া হয়, তবু তারা কথা বলেন। কারণ তারা অর্ধেক আকাশের অধিকার ছিনিয়ে নিতে জানেন। যে যুদ্ধ বহুদিনের পুরোনো। সুমিত্রার মতো নারীরা নারী দিবসের ইতিহাস হয়তো জানেন না। কিন্তু তারা প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও নারীর সমতা মানেন মনেপ্রাণে। হয়তো তারা সঠিক শব্দচয়ন জানেন না। তবু একটা ছোট্ট প্রশ্ন সুমিত্রার মতো নারী শ্রমিকের মনে উঁকিঝুঁকি দেয়, 'আমরা কেন বৈষম্যের শিকার?'
নারীর ন্যায্য মজুরির যে দাবি একশ বছরেরও বেশি সময় আগে উঠেছিল, সে দাবি কি তবে আজও অধরা?
কাস্তে আর খুন্তির কম্বিনেশন তো এতক্ষণ দেখলাম। এবারে চলুন স্টেথোকোপের সাথে সংসারের এক বিচিত্র গল্প শুনে আসা যাক। হ্যাঁ, ঠিকই আন্দাজ করেছেন। এ এক নারী চিকিৎসকের গল্প।
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় ছোটোবেলা কেটেছিল ফারজানার। ছোটো থেকেই পড়াশুনো করতে বড্ড ভালোবাসত মেয়েটি। স্বপ্ন দেখত ডাক্তার হওয়ার, মানুষের সেবা করবার। স্বপ্ন কিন্তু অধরা রইল না। মেয়েটি তার স্বপ্নকে ছুঁতে পেরেছিল। খাতা-কলম-কাগজ-বইয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর কঠোর অধ্যাবসায় স্বপ্নের ক্যানভাসকে সত্যিকারের গল্পে পরিণত করে তুললো।
সালটা ২০১১। ঢাকার আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন ফারজানা আফরিন।

এই তো বেশ কেটে যাচ্ছিল জীবন। কিন্তু ঘাত-প্রতিঘাত ছাড়া কী জীবন চলে? মেডিকেলে পড়বার সময়েই ক্যানসার ধরা পড়ল ফারজানার বাবার। মরণব্যাধি ক্যান্সার আস্তে আস্তে বদলে দিচ্ছিল পরিবারের সেই সুখী, স্বচ্ছল চিত্রটা। আশেপাশের মানুষজনও যেন বদলাতে শুরু করলো। বাবার অসুস্থতা ফারজানার প্রতি পরিবারের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। একদিকে বাবা-মায়ের দায়িত্ব, অন্যদিকে বিয়ের জন্যে সামাজিক চাপ। সাথে একাডেমিক প্রেশার তো আছেই। এসবের মধ্যে ২০১৬ সালে এমবিবিএস পাশ করে বের হন ফারজানা।
কিন্তু এই মহান সেবাব্রতীদের সেবা আর পড়াশোনার কোনো শেষ তো নেই। পোস্ট গ্রাজুয়েশন, বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি, এটা-সেটা আছেই। এরমধ্যেই বিয়ে হয়ে যায় ফারজানার। সংসার সামলানো, বাচ্চা মানুষ করা, বাবা-মার দেখভাল, চাকরি সে যেন এক গোলক ধাঁধাঁ।
যদিও বলা হয়, 'আমি নারী, আমি সব পারি।' কিন্তু সব পারা তো মুখের কথা নয়। বাবা মা, স্বামী ও ভাইবোনের সহযোগিতায় সেই কঠিন সময়টা পার করতে পেরেছিলেন ফারজানা।
যে সেবার ব্রত নিয়ে শুরু হয়েছিল তার সাধনা, সেই সেবার সুযোগ জুটে গেল এই নারী চিকিৎসকের। চাকরি জীবনে অসহায় এবং দুস্থ নারীদের চিকিৎসার জন্যে আর্থিক, মানসিক সহযোগিতা প্রদানের পাশাপাশি নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেন ডা. ফারজানা। আইনী লড়াইয়ে ক্ষেত্রে মেডিকেল সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে অন্য যেকোনো প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন তিনি।
নারীকে সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে হয়। সেক্ষেত্রে আত্মপ্রত্যয়ী না হলে বাধা ডিঙানো খুব মুশকিল।এভাবেই নিজের জীবনের নানান গল্প শুনছিলাম এই নারীর কাছ থেকে—যিনি শুধু একজন চিকিৎসকই নন, একজন মেয়ে, মা এবং স্ত্রীও বটে।
আজকের যুগে এসে নারী যেমন সামলান বাইরের দিকটা, তেমনি তার চিরাচরিত গৃহিণী রূপও বর্তমান। সানজিদা ইয়াসমিন সুমি তেমনই একজন। ইতিহাসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করে সুমি ঘর বাঁধেন তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে। চৌদ্দ বছরের সংসার জীবনে সুমি সংসারকে সাজিয়েছেন মনের মাধুরি মিশিয়ে।
ছোটোবেলা থেকেই সুমির ইচ্ছে ছিল গুছিয়ে সংসার করবার। শ্বশুর শাশুড়ির দেখাশোনা, ঘর গোছানো, ছাদ বাগান, রান্নাবান্না—একটা সংসারে কি কম কাজ? সুমি কখনই চাকরিজীবী হতে চাননি। তার মা ছিলেন সুনিপুণ গৃহিণী। মাকে দেখেই গিন্নী হওয়ার ইচ্ছেটা প্রথম দানা বেঁধেছিল তার মনে।

সুমি পড়াশোনা করেছেন সুশিক্ষিত মা হওয়ার তাগিদ থেকে। তার কাছে সংসার করাটাও একটা দায়িত্বপূর্ণ কাজই বটে। সংসারী নারী মানেই তিনি পিছিয়ে রয়েছেন এমন একখানা ধারণা আজকাল দানা বাঁধছে। কিন্তু নারী সংসারী নাকি চাকরিজীবী হবেন, সেটি একান্তই তার ব্যক্তিস্বাধীনতা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সংসারের পেছনে তার যে শ্রম, সেখানাকে তো আর মজুরির মানদণ্ড দাঁড় করানো যায় না—নিজের এসব এলোমেলো চিন্তাভাবনার কথা বলে চলেছিলেন এই গৃহিণী।
সমাজের নানানক্ষেত্রে নারীর পদচারণা ছুঁয়েছে সাফল্যের দিগন্ত। সমাজের সব প্রতিকূলতা, বৈষম্যের দেওয়াল, কুসংস্কারকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে নারী তৈরি করে চলেছেন তার যোগ্য অবস্থান। শ্রমজীবী, চাকরিজীবী, গৃহিণী কিংবা দৃষ্টিযোদ্ধা- যে যার নিজস্ব জায়গা থেকে হয়ে উঠছেন সম্পূর্ণা।
তবু লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। সমতা, ন্যায্যতা আর ন্যায়বিচারের সেইসব দাবি আজকের দিনে এসেও প্রাসঙ্গিক আলাপই বটে। নারী যেন খাঁচায় বন্দী সেই তোঁতা পাখি, যার ডানা ছিল আজীবন। তবু উড়তে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়ে বসে থাকে সমাজব্যবস্থা নামক খাঁচার মালিকেরা।
অবরোধবাসিনী ধারণাখানা বাহ্যিক নয়, বরং ভেতরকার। শুধু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কিংবা অন্দরমহল পেরোতে পারবার সক্ষমতা নয়, অবরোধবাসিনীদের মুক্ত হতে হবে মন থেকে।
ছবি: অনুস্কা ব্যানার্জী