অবৈতনিক গৃহস্থালি কাজে নারীর অবদানের মূল্য বছরে ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশে নারীরা যদি গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজের জন্য পারিশ্রমিক পেতেন, তবে এর অর্থমূল্য দাঁড়াত ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অডিটরিয়ামে প্রকাশিত হাউসহোল্ড প্রোডাকশন স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টে (এইচপিএসএ) এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈতনিক গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডের অর্থনৈতিক মূল্য হিসাব করার জন্য এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। নারীদের এই অবৈতনিক শ্রম যদি জাতীয় আয়ে (জিডিপি) যুক্ত করা হতো, তবে ২০২১ সালে চলতি মূল্যে জিডিপি অন্তত ১৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাড়ত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কাজের আর্থিক মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দুটি পদ্ধতি রয়েছে। এর একটি হলো রিপ্লেসমেন্ট কস্ট অ্যাপ্রোচ, অন্যটি অপরচুনিটি কস্ট অ্যাপ্রোচ। এর মধ্যে রিপ্লেসমেন্ট কস্ট অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করা হয়েছে।
এরপর কাজের ধরন বিবেচনা করে তিনটি পদ্ধতিতে অর্থাৎ জেনারেলিস্ট মেথড, স্পেশালিস্ট মেথড ও হাইব্রিড থেড এ অবৈতনিক কাজের আর্থিক মূল্যায়ন করা হয়।
মূলত হাইব্রিড মেথডকে বিশ্বব্যপী অবৈতনিক কাজের আর্থিক মূল্য নির্ধারণে সুপারিশ করা হয়।
হাইব্রিড পদ্ধতি অনুসরণ করে ২০২১ সালের অবৈতনিক কাজের আর্থিক মূল্য পাওয়া যায় প্রায় ৬.৭ ট্রিলিয়ন টাকা, যার মধ্যে নারীরা অবদান রেখেছেন ৮৫.৩৭% (৫.৭ট্রিলিয়ন টাকা)।
প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিবিএসের উপপরিচালক আসমা আখতার।
তিনি জানান, সময় ব্যবহার জরিপ ২০২১ এবং শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে এই হিসাব তৈরি হয়েছে। অনুষ্ঠানে ইউএন উইমেনের নুবাইরা জেহেন 'কেয়ার ক্যালকুলেটর' নামের সরঞ্জাম ব্যবহার করে দেখান, একজন মানুষ প্রতিদিন কতটা সময় অবৈতনিক কাজে ব্যয় করেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের জিডিপিতে অবৈতনিক শ্রমের অবদান ১৪.১ শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে। যদি এই অবৈতনিক শ্রমকে জিডিপির হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হতো,তাহলে অন্তত শ্রীলঙ্কার জিডিপি ১২.৩ শতাংশ,ভুটানের ১৩.৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ১৪.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেত। এই তিনটি দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।
খাদ্য বা পরিবারের ভিতরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গৃহস্থালি কাজ -যেমন বান্না, রান্না সম্পর্কিত সব কাজ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কাপড় ধোয়া, গৃহস্থালি পরিচালনা ইত্যাদি এবং খানার সদস্যদের যত্ন (খানায় শিশু, প্রবীণ ব্যক্তি, মানসিক বা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির যত্ন)-যা মূলত ব্যক্তিগত ও খানার কল্যাণে অবদান রাখে, কিন্তু যার কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে নারী ও পুরুষের গড়ে প্রায় ২ হাজার ৪৩৫ ঘণ্টা অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজে ব্যয় হয়, যার মধ্যে ৭৯% সময় অবৈতনিক গৃহস্থালি কাজে এবং বাকিটা অবৈতনিক যত্নমূলক কাজে ব্যয় করে থাকে।
অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজের মোট সময়ের মধ্যে ৮৮% সময় (২ হাজার ১৪৬ ঘণ্টা) নারীরা ব্যয় করে থাকেন। এক্ষেত্রে, অবৈতনিক গৃহস্থালি কাজের মধ্যে ৮৯% এবং যত্নমূলক কাজের ৮৬% সময় নারীরা ব্যয় করে থাকে।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী মোট তিন-চতুর্থাংশের বেশি অবৈতনিক কাজ বা গৃহস্থালি কাজ এবং দুই-তৃতীয়াংশ যত্ন বা সেবামূলক কাজ নারীরা করে থাকেন।।
প্রতিদিন নারীরা প্রায় ১২.৫ বিলিয়ন ঘণ্টা অবৈতনিক কাজ করেন, যার বার্ষিক সর্বনিম্ন মূল্য প্রায় ১০.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ এত বড় অবদান রাখা সত্ত্বেও এ কাজকে অর্থনীতিতে যথাযথভাবে গণনা করা হয় না, জাতীয় বাজেটেও এর কোনো কিছু প্রতিফলিত হয় না। ফলে নারীর এ অবদানকে সমাজ ও নীতি নির্ধারণে অবমূল্যায়ন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিবিএস ২০২১ সালে একটি টাইম ইউজ সার্ভে পরিচালনা করে, যেখানে সাধারণত দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে কতটা সময় ব্যয় করা হয়, সে সম্পর্কিত তথা সংগ্রহ করা হয়েছে।
জরিপটিতে মূলত লিঙ্গ, ভৌগোলিক অবস্থান, বয়স (১৫ বছর বা তার বেশি), বৈবাহিক অবস্থা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদির আলোকে সময় ব্যবহারের ধরনগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
ওই জরিপ অনুযায়ী, নারীরা গড়ে পুরুষদের তুলনায় ৭.৩ গুণ বেশি সময় অবৈতনিক কাজে (গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজ) ব্যয় করেন।
সুপারিশ
প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, নারীর অবৈতনিক কাজের (গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজ) স্বীকৃতি প্রদানে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় কাঠামো গড়ে তোলা দরকার।
আরও বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতিতে যত্নমূলক কাজ বা কেয়ারকে সংযুক্ত করার জন্য রাজস্ব, শ্রম এবং সামাজিক সুরক্ষা নীতিতে জেন্ডারকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা, কর্মসূচি ও বাজেট প্রণয়ন করা উচিত।
বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে মর্যাদাপূর্ণ কেয়ার চাকরি, জেন্ডার সমতাভিত্তিক কর্মক্ষেত্র নীতি এবং কেয়ার অবকাঠামোয় বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা উচিৎ। শ্রম অধিকার ও কেয়ার-সম্পর্কিত বিধিবিধান বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে বেসরকারি খাতের কার্যক্রম সমন্বিত করা দরকার বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
মজুরি বৈষম্য মোকাবিলা ও কেয়ার কাজকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া দরকার বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রধান অতিথি নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস. মুর্শিদ বলেন, 'নারীর শ্রম দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতির ছায়ায় ছিল। আজকের এই প্রতিবেদন সেই অমূল্য অবদানকে দৃশ্যমান করল।'