ইউক্রেনকে নিজ দেশের শান্তি আলোচনায় ডাকা হয়নি, ইতিহাসে এমন উদাহরণ অসংখ্য!

সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কর্মকর্তাদের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু সেখানে খোদ ইউক্রেনকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, ইউক্রেনের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো আলোচনার মাধ্যমে রাশিয়ার তিন বছর ধরে চালানো আগ্রাসনের অবসান সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত তারা 'কখনোই মেনে নেবে না'।
ইউক্রেনের অনুপস্থিতিতে তাদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত একই সঙ্গে, তাদেরকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তা বজায় রাখতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমপরিমাণ খনিজ সম্পদের দাবি এরই মধ্যে অনেক কিছু প্রকাশ করছে। এর মাধ্যমে ইউক্রেন ও ইউরোপের প্রতি ট্রাম্পের মনোভাবকেও সামনে নিয়ে এসেছে।
তবে এটা কিন্তু প্রথমবার নয়। বৃহৎ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো প্রায়ই কোনো অঞ্চলের জনগণের মতামত ছাড়াই নতুন সীমানা নির্ধারণ বা প্রভাব বলয় গঠনের জন্য গোপনে সমঝোতায় পৌঁছেছে।

এ ধরনের একপাক্ষিক ক্ষমতার রাজনীতি কখনোই ভুক্তভোগীদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনে না। ইতিহাসের সাতটি উদাহরণ তা স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে।
১. আফ্রিকাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি
১৮৮৪-৮৫ সালের এক শীতে জার্মান নেতা ওটো ফন বিসমার্ক ইউরোপের পরাশক্তিগুলোকে বার্লিনে এক সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানান। ওই সম্মেলনে পুরো আফ্রিকা মহাদেশকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। এই ঐতিহাসিক সম্মেলন পরে 'আফ্রিকাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি' নামে পরিচিতি পায়। এ সম্মেলনে কোনো আফ্রিকান প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না।
এই সম্মেলনের ফলাফলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বেলজিয়ামের নিয়ন্ত্রণে থাকা কঙ্গো ফ্রি স্টেটের সৃষ্টি। সেখানে ঔপনিবেশিক শাসনের নিষ্ঠুরতার কারণে লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়।

এছাড়াও, জার্মানিও জার্মান দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা নামে (বর্তমান নামিবিয়া) উপনিবেশ স্থাপন করে। সেখানে পরবর্তীতে উপনিবেশিত জনগণের বিরুদ্ধে বিংশ শতাব্দীর প্রথম গণহত্যা সংঘটিত হয়।
২. ত্রিপাক্ষিক কনভেনশন
শুধু আফ্রিকাই নয়, এই ধরনের বিভাজন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জেও ঘটেছিল। ১৮৯৯ সালে, জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্র সম্মেলন করে সামোয়ানদের ওপর এক চুক্তি চাপিয়ে দেয়, যার ফলে দ্বীপপুঞ্জ দুটি শক্তির মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়।
সামোয়ানরা স্পষ্টভাবে আত্মশাসন বা হাওয়াইসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর একটি কনফেডারেশনভুক্ত থাকার পক্ষে মত প্রকাশ করার পরও এটি চাপিয়ে দেওয়া হয়।
সামোয়ায় প্রভাব বিস্তারে পিছিয়ে পড়ার "ক্ষতিপূরণ" হিসেবে ব্রিটেন টোঙ্গার ওপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব লাভ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান শাসিত সামোয়া নিউজিল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সেই অবস্থায় ছিল। অন্যদিকে, আমেরিকান সামোয়া আজও যুক্তরাষ্ট্রের অঞ্চল হিসেবে রয়ে গেছে।
৩. দ্য সাইকস-পিকো চুক্তি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ ও ফরাসি প্রতিনিধিরা বসে ঠিক করেন, যুদ্ধ শেষে কীভাবে তারা অটোমান সাম্রাজ্যকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবেন। শত্রুপক্ষ হওয়ায় অটোমানদের এই আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
একসঙ্গে, ইংল্যান্ডের মার্ক সাইকস এবং ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া জর্জ-পিকো তাদের নিজ নিজ দেশের স্বার্থ অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের নতুন সীমানা নির্ধারণ করেন।
হুসেইন-ম্যাকমোহনের পত্রবিনিময় হিসেবে পরিচিত প্রতিশ্রুতিমূলক চিঠিগুলোর বিপরীত ছিল এ সাইকস-পিকো চুক্তি। চিঠিগুলোতে ব্রিটেন তুর্কি শাসন থেকে আরবদের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল।

সাইকস-পিকো চুক্তিটি বেলফোর ঘোষণার প্রতিশ্রুতিরও পরিপন্থি ছিল। কারণ বেলফোর ঘোষণায় ব্রিটেন ওসমানীয় ফিলিস্তিনে একটি নতুন ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে জিয়নিস্টদের সমর্থন দিয়েছিল।
এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক দশকের সংঘাত ও ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রপাত ঘটায়, যার প্রভাব আজও স্পষ্ট।
৪. দ্য মিউনিখ চুক্তি
১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিন এবং ফরাসি প্রধানমন্ত্রী এদুয়ার দালাদিয়ে ইতালির ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনি ও জার্মানির অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন এবং মিউনিখ চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
হিটলারের নাৎসি বাহিনী একটি বিদ্রোহ উসকে দেওয়ার পরে এবং সুডেটেনল্যান্ড নামে পরিচিত চেকোস্লোভাকিয়ার জার্মান-ভাষী অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ শুরু করার পরে নেতারা ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধের বিস্তার রোধের চেষ্টা করেছিলেন। তারা জার্মান সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার অজুহাতে এটি করেছেন। এখানেও কোনো চেকোস্লোভাকিয়ানকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
অনেকে এখনো এই বৈঠককে 'মিউনিখ বিশ্বাসঘাতকতা' বলে অভিহিত করেন। এটি যুদ্ধ বন্ধ করার মিথ্যা আশ্বাসের একটি বড় উদাহরণ ছিল। কারণ এটি করাই হয়েছিল যুদ্ধরত শক্তিদের তুষ্ট করার জন্য।
৫. দ্য এভিয়ান সম্মেলন
১৯৩৮ সালে জার্মানিতে নাৎসি বাহিনীর নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা ইহুদি শরণার্থীদের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে ফ্রান্সের এভিয়ান-লে-বাঁ শহরে ৩২টি দেশ একটি সম্মেলনে মিলিত হয়।
সম্মেলন শুরুর আগে, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র একমত হয় যে তারা পরস্পরের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে না যাতে উভয় দেশ তাদের নির্ধারিত কোটার বাইরে অতিরিক্ত ইহুদিদের গ্রহণ করতে বাধ্য না হয়। হোক তা যুক্তরাষ্ট্রে বা ব্রিটিশ অধিকৃত ফিলিস্তিনে।
সম্মেলনে ভবিষ্যৎ ইসরায়েলি নেতা গোল্ডা মেয়ার পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত থাকলেও তিনিসহ কোনো ইহুদি প্রতিনিধিকে আলোচনা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।
সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বেশিরভাগই ইহুদি শরণার্থীদের গ্রহণ করার বিষয়ে একমত হতে ব্যর্থ হয়, ব্যতিক্রম ছিল কেবল ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র। ফলে, জার্মানিতে থাকা অধিকাংশ ইহুদি নাৎসি বাহিনীর গণহত্যার শিকার হওয়ার আগে দেশ ছাড়তে পারেননি।
৬. দ্য মলোটভ-রিবেনট্রপ প্যাক্ট
হিটলার যখন পূর্ব ইউরোপ আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন, তখন তার প্রধান বাধা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই সমস্যার সমাধান হিসেবে, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটি কূটকৌশলপূর্ণ অগ্রাসনবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

এই চুক্তি সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভায়াচেস্লাভ মলোটভ এবং জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াকিম ফন রিবেনট্রপের নামে পরিচিত। এটি নিশ্চিত করেছিল, হিটলার যখন পোল্যান্ড আক্রমণ করবে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। পাশাপাশি, এই চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপকে নাৎসি ও সোভিয়েত প্রভাব বলয়ে বিভক্ত করা হয়। এর ফলে সোভিয়েতরা রোমানিয়া ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোতে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারে, ফিনল্যান্ডে হামলা চালায় এবং পোল্যান্ডের একটি অংশ দখল করে নেয়।
অপ্রত্যাশিত নয় যে, পূর্ব ইউরোপের অনেকেই বর্তমানে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার আলোচনাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছোট দেশগুলোকে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার এই গোপন কূটনীতির পুনরাবৃত্তি হিসেবে দেখছেন।
৭. দ্য ইয়াল্টা সম্মেলন
জার্মানির নাৎসি বাহিনীর পরাজয় যখন আসন্ন, তখন ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, সোভিয়েত স্বৈরশাসক জোসেফ স্টালিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট পরবর্তীতে ইউরোপের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে একত্রিত হন। এই বৈঠক ইতিহাসে 'ইয়াল্টা সম্মেলন' নামে পরিচিত হয়ে আছে।
পটসডাম সম্মেলনের কয়েকমাস পর এ ইয়াল্টা সম্মেলন ইউরোপের রাজনৈতিক কাঠামো গড়তে সহায়তা করেছিল। অবশ্য এটি পরবর্তীতে চলমান স্নায়ুযুদ্ধের কারণে ইউরোপে বিভেদ তৈরি করেছিল।
ইয়াল্টা সম্মেলনে 'বিগ থ্রি' নেতারা জার্মানিকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন এবং পাশাপাশি স্টালিনকে পূর্ব ইউরোপে একটি প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রও দেওয়া হয়।
এর ফলে পূর্ব ইউরোপে একাধিক রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত বাফার রাষ্ট্র তৈরি হয়। অনেকের মতে, আজকের দিনে পুতিন পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে এ নীতি পুনরায় বাস্তবায়ন করতে চাইছেন।