রাজউকের প্লট হস্তান্তর আরও সহজ হবে

সরকারের কাছ থেকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দলিলপ্রাপ্ত প্লট ও ফ্ল্যাট বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি উক্ত সম্পত্তি বিক্রয়, দান, হেবা ও আম-মোক্তার দলিল করতে আর সরকারি দপ্তরের অনুমোদন নিতে হবে না। এতে লিজগ্রহীতারা বিপুল পরিমাণ অর্থ ঘুষ দেওয়া থেকে রেহাই পাওয়ার পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক হয়রানি থেকেও মুক্তি পাবেন।
একইসঙ্গে বেসরকারি ডেভেলপাররা তাদের সাফ কবলামূলে বিক্রির ভূমি ও ফ্ল্যাট হস্তান্তরকালে পূর্বানুমোদনের নামে ক্রেতাদের কাছ থেকে যে বাড়তি টাকা আদায়ের পাশাপাশি হয়রানি করছেন, সেটিও বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
লিজগ্রহীতা জনগণের দূর্ভোগ ও ভোগান্তি লাঘব এবং সরকারি দপ্তরের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে বিদ্যমান প্রথা ও পদ্ধতি পরিবর্তন করতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য বিদ্যমান আইন, বিধিমালা ও প্রবিধানমালায়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তবে কোন প্লটের বিভাজন বা একাধিক প্লট একত্রীকরণের মাধ্যমে প্লটের আয়তন পরিবর্তন, এবং প্লট বা ফ্ল্যাটের শ্রেণির পরিবর্তন বা মাস্টারপ্ল্যানের কোন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি গ্রহণের বর্তমান পদ্ধতি বহাল থাকবে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব মো. নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে গত ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ওই সভায় ভূমি মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, নিবন্ধন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, সভায় পূর্ত সচিব নজরুল ইসলাম বলেছেন, ''দীর্ঘমেয়াদে লিজগ্রহীতা হওয়ার পরও বিভিন্ন ধাপে অনুমোদন গ্রহণের বাধ্যবাধকতা লিজগ্রহীতা বা তার উত্তরাধিকারীদের জন্য নানাভাবে হয়রানি ও ভোগান্তির সৃষ্টি করছে এবং বিদ্যমান প্রথা ও পদ্ধতিতে এই ধরণের হয়ারানি ও ভোগান্তি বছরের পর বছর এবং বংশপরস্পরায় চলমান থাকবে। এ ধরণের প্রথা চালু থাকায়, সংশ্লিষ্ট নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়েছে।''
তিনি বলেন, এমনকী সরকারি দপ্তরের অনুকরণে সম্প্রতি বেসরকারি ভূমি ডেভেলপাররাও তাদের সাফ কবলামূলে বিক্রিত ভূমি বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রেও—পরবর্তী হস্তান্তরকালে পূর্বানুমোদনের নামে ক্রেতাগণকে হয়রানি করছে এবং তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ থেকে জনগণকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে এসব অনুমোদনের জন্য লিজদাতা প্রতিষ্ঠান তাদের আয়ের জন্য একটি ফি নিয়ে থাকে। তাদের আয় যাতে না কমে—সেজন্য প্লট, ফ্ল্যাট, স্পেস বা দোকান হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে লিজদাতা সংস্থার অনুকূলে নির্ধারিত কোডে বা ব্যাংক হিসাবে পে-অর্ডারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অর্থ আদায় করা হবে।
"অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে"- বলেও জানান তিনি।
যেসব সম্পত্তি ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রাউজক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও প্রধান প্রধান জেলাগুলোর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় প্লট ও ফ্ল্যাট লিজ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। ঢাকায় ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরা, পূর্বাচল ও ঝিলমিল প্রকল্পের প্লট ও ফ্ল্যাট লিজ বরাদ্দ দিয়েছে রাজউক।
এছাড়া এই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সাধারণত আবাসিক ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্ল্যাট এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ভবন ও জমি লিজ দিয়ে থাকে। এছাড়াও, তারা বিভিন্ন ধরনের প্লট এবং ডেভেলপারদের সাথে যৌথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জমি লিজ দিয়ে থাকে।
বিদ্যমান ব্যবস্থার আওতায়, লিজগ্রহীতাকে উক্ত সম্পত্তি বিক্রয়, দান, হেবা, আম-মোক্তার দলিল সম্পাদন বা বন্ধকী ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পূর্বানুমোদন নিতে হয়।
এছাড়া বিক্রির দলিল সম্পাদনের পর কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকানা লাভের ক্ষেত্রে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর দপ্তরে নাম জারীর পূর্বে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানে নামজারির অনুমতি গ্রহণ করতে হয়।
রাজউকের ঝিলমিল প্রকল্পে জমি বরাদ্দ পাওয়া একজন নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, "লিজের জমি বরাদ্দ পাওয়ার পর পুরোপুরি টাকা পরিশোধ করে—লিজদলিল সম্পন্ন করতেই রাজউকে কমপক্ষে ২/৩ মাস ধর্না দিতে হয়। অথরাইজড অফিসার বেশিরভাগ সময় সিটে থাকেন না, থাকলেও নানা ব্যস্ততা দেখিয়ে এদিন-সেদিন আসতে বলেন। এভাবে লোকজনকে হয়রানি করে বাড়তি টাকা নিয়ে দলিল করে দেন তারা।"
"এছাড়া সেল পারমিশন বা বিক্রি করতে চাইলে টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হয়। কর্মকর্তারা অযথা কালক্ষেপণ করে হয়রানি করার মাধ্যমে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে কাজ করে দেন। যারা ঘুষ দিতে চান না—তাদের ভোগান্তির কোনো শেষ নেই" - তিনি যোগ করেন।
লিজ সম্পত্তির উত্তরাধিকার
পূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, কোনো ব্যক্তি রাউজক থেকে প্লট বা ফ্ল্যাট ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেওয়ার পর তিনি যখন মারা যান—তখন স্বাভাবিকভাবেই তার সন্তানরা উত্তরাধিকার হিসেবে ওই সম্পত্তির মালিক হন। ওই সম্পত্তি উত্তরাধিকারদের নামে নামজারি হওয়ার কথা সংশ্লিষ্ট থানার এসিল্যান্ড অফিসে। কিন্তু বিদ্যমান লিজপ্রথার শর্ত অনুযায়ী, আগে উত্তরাধিকারীদের রাজউকে এসে তাদের নামে নামজারি করাতে হয়, পরে ওই ডকুমেন্ট নিয়ে এসিল্যান্ড অফিসে নামজারি করাতে হয়।
"এ কাজের রাউজক কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্টদের কাছে নানা রকমের ডকুমেন্ট চেয়ে হয়রানি করেন, সেবাগ্রহীতাকে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়, হয়রানি হতে হয়। তারা অনেকটা বাধ্য হয়ে মোটা অংকের ঘুষ দিতে বাধ্য হন"- বলেন ওই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, মূল মালিক মারা যাওয়ার পর তার উত্তরাধিকাররা এখন ঘুষ দিয়ে তাদের নামে নামজারি করলেই যে সমস্যা মিটে গেলো তা নয়। এখনকার উত্তরাধিকাররা মারা গেলে তাদের উত্তরাধিকারদেরও একইভাবে নামজারি করতে হবে। লিজকৃত সম্পত্তি নিয়ে এভাবেই বংশ পরম্পরায় জনগণ হয়রানির পাশাপাশি ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছে।
"লিজকৃত সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর, ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া কিংবা হেবা, দান ও আম-মোক্তার করার ক্ষেত্রেও একই ধরণের হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন লিজগ্রহীতারা"- জানান ওই কর্মকর্তা।
আবাসন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন- রিয়েল এস্টেট এন্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া এ উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, "৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়ার অর্থই হলো লিজগ্রহীতা ওই সম্পত্তির বৈধ মালিক। তারপরও প্লট বা ফ্ল্যাট হস্তান্তর, দান, হেবাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়রানি ছাড়া আর কিছুই না। সরকার এসব প্রথা বাতিল করলে তা খুবই ইতিবাচক হবে।"
বেসরকারিখাতের কোম্পানিগুলোও সাফ-কবলা দলিল মূলে ফ্ল্যাট ও প্লট বিক্রির পর— ক্রেতা পরবর্তীতে তা অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করতে গেলে—কোম্পানির কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে এটিও 'যৌক্তিক নয়' বলে মন্তব্য করেন তিনি।