বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব জীবন যেভাবে মসৃণ করতে পারে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা
রহমান আজিজ (ছদ্মনাম), ষাটোর্ধ্ব একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন বহু আগে। একমাত্র সন্তান থাকেন বিদেশে। তাই অফিস থেকে দিনশেষে যখন ঘরে ফেরেন, তখন তিনি একেবারেই একা। 'মাঝে মাঝে খুব একা লাগে,' দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন তিনি।
পরিসংখ্যান বলছে, রহমান আজিজের মতো এমন অনুভূতি যাদের, সেই সংখ্যায় তিনি একা নন। 'আদমশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২' অনুযায়ী, দেশে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখের বেশি। এটি দেশের মোট জনসংখ্যার ৯.২৮ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু ৭৪.০৬ বছর। সে অনুযায়ী ৬০ বছরের পরের সময় অনেকটা জীবনের শেষ মাইলে হাঁটার মতো। তবে বেশিরভাগে মানুষের জন্য এই হাঁটাচলা বা জীবনের শেষ সময়টুকু মোটেও মসৃণ নয়।
জীবনের শেষ কয়েক দশকে পদার্পণ করার সময় অনেকেই বার্ধক্যজনিত রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হন। ভঙ্গুর স্বাস্থ্য, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, একাকীত্বের মানসিক ধকল এবং মৃত্যুভয়ের মত বিষয়গুলো নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।
মানসিক স্বাস্থ্যের সংগ্রাম
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ঝুনু শামসুন নাহার জানান, প্রবীণদের মধ্যে বিষণ্নতা এবং আলঝেইমার্সের মতো নিউরোকগনিটিভ ডিজঅর্ডার বা মানসিক স্বাস্থ্যজনিত চ্যালেঞ্জগুলো বিশেষভাবে দেখা যায়।
তিনি বলেন, 'বিষণ্নতা প্রকাশ পায় দীর্ঘস্থায়ী দুঃখবোধ, আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এবং শক্তি কমে যাওয়ার মাধ্যমে। গুরুতর ক্ষেত্রে এটি আত্মহত্যার চিন্তার দিকেও নিয়ে যেতে পারে, যেখানে নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।'
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, 'অন্যদিকে ডিমেনশিয়ার বৈশিষ্ট্য হলো স্মৃতিশক্তি ধীরে ধীরে লোপ পাওয়া। এতে প্রবীণরা প্রায়ই সাম্প্রতিক ঘটনা ভুলে যান অথচ অতীতের কথা স্পষ্টভাবে মনে রাখতে পারেন। বয়স্কদের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের এই অবনতির প্রভাব বার্ধক্যের অন্যান্য দিকগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরও জটিল আকার ধারণ করে। অনেক বয়স্ক মানুষ বিশেষ করে প্রিয়জনদের হারানোর পর যে একাকীত্ব অনুভব করেন তা তাদের বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয়। শারীরিক অসুস্থতা এই অসহায়ত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে।'
ডা. নাহারের মতে, 'ধর্ম মানুষকে প্রশান্তি ও জীবনের একধরণের কাঠামো দিতে পারে কিন্তু যখন মৃত্যুচিন্তা প্রধান হয়ে ওঠে, তখন ভয় ও উদ্বেগ অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। তাই শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক সুস্থতার দিকে নজর দেওয়াটাও সমান জরুরি।'
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, 'পরিবার ও পরিচর্যাকারীদের উচিত তাদের বয়স্ক প্রিয়জনদের মধ্যে বিষণ্নতা বা মানসিক অবনতির লক্ষণগুলো খেয়াল রাখা। নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, বিভ্রান্তি এবং ক্ষুধামন্দা এগুলো সতর্কবার্তা।' প্রবীণদের সামাজিক ও মানসিকভাবে উদ্দীপকমূলক কাজে যুক্ত রাখা যেমন সামাজিক কর্মকাণ্ড বা নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটানো তাদের জীবনের উদ্দেশ্য ফিরিয়ে দিতে এবং সামগ্রিক সুস্থতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
যখন শেষ হয় না আর্থিক চাপ
মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি আর্থিক পরিকল্পনা আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয়। অনেক প্রবীণ নাগরিকের পর্যাপ্ত সঞ্চয় বা অবসরের সুযোগ-সুবিধা না থাকায়, আর্থিক অনিশ্চয়তা প্রায়ই তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার নিরন্তর সংগ্রামে পরিণত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক মাহতাব উদ্দিন ৬০ বছরের পর অধিকাংশ নাগরিকের জন্য অপেক্ষমান বাস্তবতার একটি করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। অবসরের দিকে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশিরা আর্থিকভাবে প্রস্তুত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মাহতাব উদ্দিন বলেন, 'আমার মনে হয় না আমরা মোটেও প্রস্তুত। জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশের কোনো না কোনো ধরনের আর্থিক নিরাপত্তা রয়েছে। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক খাতের চাকরির হার অন্যতম সর্বনিম্ন এবং সেই খাতের মধ্যেও সবাই অবসরের সুবিধা পান না।'
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, অধিকাংশ বাংলাদেশি প্রবীণ বয়সে পদার্পণ করেন কেবল আর্থিক অনিশ্চয়তা নিয়েই নয় বরং ভঙ্গুর শরীর নিয়ে।
'আমাদের প্রবীণরা শুধু বয়স্কই নন, তারা অসুস্থও। বছরের পর বছর দূষিত বাতাস, অনিরাপদ পানি এবং অস্বাস্থ্যকর খাবারের কারণে উন্নত দেশগুলোর প্রবীণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় তাদের রোগের বোঝা অনেক বেশি। এই একটি কারণেই তাদের আর্থিক প্রস্তুতির প্রয়োজন অনেক বেশি, যা অধিকাংশ মানুষেরই নেই।'
অর্থনীতি কি প্রবীণদের প্রতি সদয়?
অধ্যাপক মাহতাব মনে করেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রবীণদের স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচার অনুকূল নয়। তিনি এর পেছনে তিনটি প্রধান বাধা চিহ্নিত করেছেন: 'প্রথমত, জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে ৮-১০ শতাংশের আশেপাশে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে পরিবহন সরকারি পরিষেবার মান খুবই নিম্নমানের এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পূর্ণ। সবশেষে, নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান দৈনন্দিন জীবনকে কঠিন করে তোলে, বিশেষ করে প্রবীণদের জন্য।'
তিনি আরও যোগ করেন, 'এমনকি সাধারণ চলাফেরা করাটাও তাদের জন্য সংগ্রামের। হুইলচেয়ারে বসা ৭৫ বছর বয়সী কেউ কি ঢাকার বাসে উঠতে পারবেন? অনেক দেশে গণপরিবহন এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেন বয়স্করা ব্যবহার করতে পারেন। আমরা তা থেকে অনেক দূরে।'
মাহতাব উদ্দিন উল্লেখ করেন, চিকিৎসা ব্যয় প্রবীণদের ওপর প্রধান আর্থিক বোঝা। 'আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা দুই স্তরে চলে। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখানো হয়তো ফ্রি কিন্তু ডায়াগনস্টিক টেস্ট এবং ওষুধ ব্যয়বহুল এবং অনেক সময় অপ্রয়োজনীয়।'
তিনি ভবিষ্যতের ঝুঁকির কথাও স্মরণ করিয়ে দেন: 'এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তকমা থেকে উত্তরণের পর অনেক ওষুধের দাম বেড়ে যাবে। কারণ আমরা তখন ট্রিপস-এর আওতাধীন ছাড়গুলো আর পাবোনা।'
একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পথে
যারা ইতিমধ্যে ৬০-এ পা দিয়েছেন তাদের জন্য টিকে থাকাই প্রধান চিন্তা। অধ্যাপক মাহতাব ব্যাখ্যা করেন, 'অধিকাংশ প্রবীণের সঞ্চয় বা অবসর সুবিধা নেই। তাদের খরচ শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ; খাবার, ওষুধ এবং বাসস্থান। স্বাস্থ্যকর খাবার এবং নিয়মিত চেকআপ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত কিন্তু অনেকেই তা বহন করতে পারেন না।'
তিনি উল্লেখ করেন, 'প্রকৃত আর্থিক পরিকল্পনা পেনশন স্কিম, সঞ্চয় এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে কয়েক দশক আগেই শুরু করতে হবে।'
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি কম ঝুঁকিপূর্ণ বিকল্প বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেন। 'সরকারি সঞ্চয়পত্রগুলো বয়স্কদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। শেয়ার বাজারে ঝুঁকি থাকে, এমনকি তুলনামূলক স্থিতিশীল ফান্ডগুলোতেও।' তবে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অবসরপ্রাপ্তদের মধ্যে একটি বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। সরকারি কর্মচারীরা সাধারণত পেনশন পান কিন্তু বেসরকারি খাতের কর্মীরা প্রায়ই তা পান না।
পেনশনের মাধ্যমে কিছুটা আর্থিক স্থিতিশীলতা থাকলেও, অনেক প্রবীণ জীবনযাত্রার ব্যয় এবং স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারের সীমিত সহায়তার সমালোচনা করে অধ্যাপক মাহতাব বলেন, '৬০০-৭০০ টাকার বয়স্ক ভাতা অর্থহীন। এতে কিছুই হয় না। আমাদের সর্বজনীন বয়স্ক সুরক্ষা প্রয়োজন, যার সুবিধা অন্তত আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা পূরণ করবে।'
তিনি আবারও জোর দিয়ে বলেন, 'সহায়তা কেবল অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। প্রবীণদের জন্য একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন যার মধ্যে থাকবে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা, সহজলভ্য পরিবহন এবং সম্মানজনক সরকারি পরিষেবা।'
