ট্রাম্প কেন ইউক্রেন ও গাজায় যুদ্ধ থামাতে পারছেন না
যখনই মনে হয়েছে, তাঁর পররাষ্ট্রনীতি কিছুটা 'স্থিতিশীলতা' পেতে শুরু করেছে, তখনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নতুন মোড় এনে দিয়েছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যেসব আল্টিমেটাম তিনি দিয়েছেন, সেগুলোর সময়সীমা হঠাৎই অর্ধেকেরও কম করে ৫০ দিন থেকে ১০ দিনে নামিয়ে এনেছেন। ট্রাম্প পুতিনের ওপর বেজায় বিরক্ত, এটি তারই ইঙ্গিত। ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর পথে পুতিনই এখন তাঁর প্রধান অন্তরায় বলে মনে করছেন ট্রাম্প।
একইভাবে, ট্রাম্পের বহুল প্রচারিত আরেকটি পররাষ্ট্রনীতি—গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটানো—সেখানেও দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। যখন গাজা উপত্যকায় মানবিক বিপর্যয় দিন দিন গভীরতর হচ্ছে, তখন ট্রাম্প এবং তাঁর কিছু 'মাগা' (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) ঘরানার অনুসারী প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। প্রায় দুই বছরের এই যুদ্ধের পর গাজার সিংহভাগ বাসিন্দা বাস্তবিকই দুর্ভিক্ষ ও অনাহারের মধ্যে রয়েছেন—এ কথা এখন অস্বীকার করারও উপায় নেই।
তবে ইউক্রেন বা গাজায় ট্রাম্প শান্তি ফেরাতে যতটা ব্যর্থ হয়েছেন, বিশ্ব রাজনীতির অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে তিনি কিছুটা হলেও সফল হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর (ডিআরসি) মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করাতে পেরেছে, যা উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ২৭ জুন ওয়াশিংটনে স্বাক্ষর করেছেন।
এছাড়া, গত মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চার দিনব্যাপী লড়াই থামিয়ে একটি যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতার দাবিও করেছেন ট্রাম্প। এই সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার পর। নয়াদিল্লি তাৎক্ষণিকভাবে যার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং প্রতিশোধ নিতে সামরিক পদক্ষেপ নিলে– দুই দেশ সংঘাতে জড়ায়।
সম্প্রতি জুলাইয়ে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংঘর্ষ থামাতেও নাকি ট্রাম্পই উভয় দেশের নেতাদের চাপ দিয়ে সমঝোতায় এনেছেন।
এই সব যুদ্ধবিরতি এখন পর্যন্ত কার্যকর রয়েছে। কিন্তু গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে জানুয়ারিতে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে যে ক্ষণিকের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল, সেটি মার্চে এসে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে এবং এরপর থেকে সংঘর্ষ আরও বেড়েছে। ইউক্রেনে এপ্রিলে যেটিকে যুদ্ধবিরতি বলা হয়েছিল, বাস্তবে সেটি ছিল কার্যত অর্থহীন, কারণ নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনই হয়ে উঠেছিল স্বাভাবিক ঘটনা। আর সেই সংঘাতের স্রোতেই নিভে যায় যুদ্ধবিরতির ক্ষীণ আশার আলো।
মিশ্র ফলাফল ও তিনটি ব্যাখ্যা
ট্রাম্পের এই শান্তি প্রতিষ্ঠা চেষ্টার সাফল্য ও ব্যর্থতার পেছনে তিনটি মূল কারণ রয়েছে।
প্রথমত, ট্রাম্প সাধারণত যেখানে তাঁর প্রভাব প্রয়োগ করতে পারেন এবং তা প্রয়োগ করতে ইচ্ছুক হন, সেখানেই তিনি সফল হয়েছেন। যেমন, থাইল্যান্ড বা কম্বোডিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা শুরু হবে না, যতক্ষণ না সংঘর্ষ বন্ধ হয়—এমন হুমকি স্পষ্টভাবে দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে এই কৌশল খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। সেখানে ট্রাম্প শুধু ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে চাপে ফেলেন, যার ফলস্বরূপ দুই সপ্তাহের মধ্যেই একটি ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হন জেলেনস্কি। তবে রাশিয়ার ক্ষেত্রে এমন হুমকির প্রভাব তেমন পড়েনি। ট্রাম্প যেসব নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিলেন, সেগুলো কখনোই কার্যকর করেননি। জানুয়ারি ও মে মাসে এসব হুমকি মস্কোকে মোটেও নরম করেনি। এখনো হোয়াইট হাউসের সর্বশেষ আল্টিমেটামের প্রতি ক্রেমলিনের প্রতিক্রিয়াতেও তেমন কোনো নমনীয়তার ইঙ্গিত নেই।
দ্বিতীয়ত, কোথায় ট্রাম্প সফল হবেন আর কোথায় হবেন না, তা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের জটিল স্বার্থের ওপর। রাশিয়া ও ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শুধু যুদ্ধ নয়—বহুমাত্রিক, কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে গভীরভাবে সংযুক্ত। এই সম্পর্কের যেকোনো পরিবর্তন ট্রাম্পের রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অবস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে।
ট্রাম্প এখনো রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে একটি 'গ্র্যান্ড বারগেইন' করতে চান—যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া একে অপরের প্রভাব অঞ্চলে হস্তক্ষেপ না করার ব্যাপারে সম্মত হবে। এই উচ্চাভিলাষী চুক্তির আশায়, ট্রাম্প এখনো পুতিনকে চূড়ান্তভাবে চাপে ফেলছেন না।
ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও ট্রাম্পকে হিসেব করে চলতে হচ্ছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মিত্রদের স্বার্থ রক্ষা—এই দুইয়ের টানাপোড়েনে ট্রাম্প চাইলেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারছেন না। দেশে তাঁর রক্ষণশীল সমর্থকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়াও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে, রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর চুক্তিটি তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের জন্য পূর্ব কঙ্গোর খনিজসম্পদে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করাই ছিল যার মূল লক্ষ্য। প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স চিসেকেদি নিজেই ট্রাম্পকে প্রতিশ্রুতি দেন—যদি রুয়ান্ডাকে চাপে ফেলে চুক্তিতে আনা যায়, তবে কঙ্গো যুক্তরাষ্ট্রকে খনিজসম্পদে প্রবেশাধিকার দেবে।
সরল সমাধান বনাম জটিল সংকট
এখানেই আসছে তৃতীয় কারণ—সমস্যা সরল হলে সমাধানও সহজ হয়। থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া বা ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্ষে উভয় পক্ষ আগের অবস্থানে ফিরে গেলেই শান্তি ফিরে আসে। এটি দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান নয়, কিন্তু সহিংসতা থেমে যায়। এসব সংঘর্ষে যেসব বার্তা দিতে হয়েছিল, উভয় পক্ষ তা দিয়েই ফেলেছে। ফলে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও খুব সীমিত।
কিন্তু ইউক্রেন বা মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতি অনেক জটিল। সেখানে যুদ্ধ থামাতে হলে দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক অংশগ্রহণ, নিখুঁত পরিকল্পনা ও কঠোর বাস্তবতাকে আমলে নেওয়া লাগে। এই অঞ্চলে আগের পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়া এখন আর কোনো পক্ষের স্বার্থে নেই।
এমন একটি পরিস্থিতিতে যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে ধাপে ধাপে চুক্তির পথে এগিয়ে নিতে হলে একটি সুনির্দিষ্ট এবং সুগঠিত প্রক্রিয়া প্রয়োজন। সেটি ইউক্রেনে নেই এবং গাজায় কার্যত ব্যর্থ।
বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে ট্রাম্প প্রশাসনের কাঠামোগত দুর্বলতা। পররাষ্ট্র দপ্তরের বাজেট ও জনবল ছাঁটাইয়ের কারণে মার্কো রুবিও এখন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। ট্রাম্প নির্ভর করছেন কিছু ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত দূতের ওপর, যাদের পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা সীমিত। সবকিছু তিনি নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে চান—এই মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর কূটনীতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
এই অবস্থা শেষ পর্যন্ত একটি আত্মঘাতী সুযোগহানির চিত্র তৈরি করছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়—যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের কোটি কোটি মানুষের জন্যও এটি একটি দীর্ঘশ্বাসের উপলক্ষ।
লেখক: স্টেফান উল্ফ যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ের অধ্যাপক। ভূরাজনীতির নানান ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এশিয়া টাইমসে নিয়মিত বিশ্লেষণী কলাম লেখেন তিনি।
