পড়ে আছে ৩৫৮ কোটি টাকার লাগেজ ভ্যান, বেসরকারি খাতে ছাড়ার চিন্তা রেলওয়ের

পণ্য পরিবহনের আয় বাড়াতে দেড় বছর আগে ৩৫৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কিনেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করা হলেও দুর্বল পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবে এই ভ্যানগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত আয় তো বাড়েইনি, বরং উল্টো কমেছে।
বর্তমানে নতুন কেনা লাগেজ ভ্যানগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবহার হচ্ছে না—অলস পড়ে আছে।
লাগেজ ভ্যান মূলত একটি বিশেষ ধরনের রেল কোচ, যা পণ্য, লাগেজ এবং দ্রুত নষ্ট হয়–এমন দ্রব্য পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যবহারযোগ্যতা যাচাই ছাড়াই ভ্যানগুলো আমদানি করায় এখন তা রেলের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এসব লাগেজ ভ্যান বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়ার বা ব্যবহার নিশ্চিত করার পথে হাঁটছে রেলওয়ে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরিবহনবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ মুখে মুখে অনেক বড় বড় কথা বলে—যে লাগেজ ভ্যান ও ওয়াগন কিনলে পণ্য পরিবহন বাড়বে। কিন্তু লাগেজ ভ্যান কেনার আগে সঠিকভাবে কার্যকারিতা যাচাই করা হয়নি।"
তিনি বলেন, "অনেক সময় সরবরাহকারীদের সুবিধা করে দিতেই এমন কেনাকাটা হয়। এর দায় কেউ নেয় না। সরকারকে উচিত তদন্ত করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।"
কেনার পরিকল্পনায় কী ছিল
রেলওয়ের তথ্যমতে, 'বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং অপারেশন উন্নয়ন কারিগরি সহায়তা' প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট চীনের একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মোট ৩৫৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকার চুক্তি করে রেলওয়ে।
এই অর্থে কেনা হয় ৭৫টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান। মিটারগেজ ভ্যানের প্রতিটির দাম ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং ব্রডগেজ ভ্যানের দাম ৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। প্রতিটি ভ্যানের পণ্য বহনের সক্ষমতা ১০ টন।
রেল পরিবহন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ধাপে ধাপে নতুন লাগেজ ভ্যানগুলো রেলের বহরে যুক্ত হয়। এরমধ্যে ২৫টি ছিল রেফ্রিজারেটর লাগেজ ভ্যান।
রেলওয়ের তথ্য বলছে, নতুন ১২৫টি ও পুরনো ৫০টি মিলিয়ে মোট ১৪৩টি লাগেজ ভ্যানের মধ্যে বর্তমানে সচল ভ্যান আছে মাত্র ৬৩টি। এরমধ্যে পূর্বাঞ্চলে চলছে ২১টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে চলছে ২৪টি।
এছাড়া দুই অঞ্চলে গাড়ি বহনকারী ১০টি ভেইকল লাগেজ ভ্যান (ভিকে) এবং গার্ড বহনের ৮টি গার্ড ব্রেক ব্যবহার হচ্ছে।
তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো—আড়ম্বরপূর্ণভাবে আমদানি করা ২৫টি রেফ্রিজারেটর লাগেজ ভ্যান এখন পর্যন্ত একদিনও ব্যবহার হয়নি।
সম্প্রসারণের পরেও আয় কমেছে
নতুন লাগেজ ভ্যান যুক্ত হওয়ার আগে, ২০২৩ সালের প্রথম আট মাসে রেলওয়ের লাগেজ ভ্যান থেকে আয় হয়েছিল ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ওই সময়ে ৪০ বছরের পুরনো ভ্যানে পণ্য পরিবহন হয়েছিল ৭০ হাজার ৯০০ টন।
আর লাগেজ ভ্যান যুক্ত হওয়ার পর ২০২৪ সালের প্রথম আট মাসে আয় হয়েছে মাত্র ৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এ সময়ে পরিবহন করা হয়েছে ৫৯ হাজার ৪০০ টন পণ্য—অর্থাৎ ভ্যানের সংখ্যা বাড়লেও রাজস্ব কমেছে।
রেল কর্মকর্তারা জানান, ব্যবহার বাড়াতে লাগেজ ভ্যান শুধু মেইল নয়, আন্তঃনগর ট্রেনেও যুক্ত করা হয়। কিন্তু আন্তঃনগর ট্রেন সব স্টেশনে থামে না। যেখানে থামে, সেখানেও বিরতি থাকে মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিনিট। ফলে পণ্য ওঠানামার সময় পাওয়া যায় না। ফলে এই পরিকল্পনাও কার্যকর হয়নি।
২০২৩ সালের ২৪ অক্টোবর রেলওয়ে খুলনা, পঞ্চগড় ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর থেকে তিন জোড়া 'কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন' চালু করে লাগেজ ভ্যান ব্যবহারে গতি আনতে। কিন্তু কৃষকদের সাড়া না পেয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই তা বন্ধ করতে হয়।
রেল কর্মকর্তারা জানান, অনেক ট্রেনে দুই লাখ টাকার ডিজেল খরচ হলেও আয় হয়নি দুই হাজার টাকাও। কিছু ট্রেন পণ্য ছাড়াই চলেছে।
মূল্য ও লজিস্টিকস প্রতিবন্ধকতা
রেলওয়ের তথ্যমতে, লাগেজ ভ্যানে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে প্রতিকেজি পণ্যের ভাড়া ২ টাকা ৩৬ পয়সা। অথচ সড়কপথে এই ভাড়া ১ টাকা ৬৮ পয়সা থেকে ২ টাকার মধ্যে পড়ে।
ট্রাকে যশোর থেকে ঢাকায় সবজি পাঠাতে প্রতি কেজিতে খরচ পড়ে ২ টাকা। অথচ ট্রেনে পাঠাতে খরচ পড়ে প্রায় সাড়ে ৪ টাকা, কারণ কয়েকবার পণ্য ওঠা-নামার প্রয়োজন হয়। এতে নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে। ফলে রেলে পণ্য পরিবহনের জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে।
বাজার পর্যালোচনার অভাব
লাগেজ ভ্যান ক্রয়সহ অন্যান্য রোলিং স্টক সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমীক্ষা করা হলেও কৃষক বা ব্যবসায়ীদের চাহিদা যাচাই করা হয়নি। করোনাকালসহ গত দেড় দশকে রেলওয়ের প্রায় ৯৩টি ট্রেন সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে, যার অধিকাংশই ছিল মেইল ও লোকাল ট্রেন—যেখানে লাগেজ ভ্যান ব্যবহৃত হতো।
রেলওয়ের যুগ্ম পরিচালক (অপারেশন) মো. শহিদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দীর্ঘদিন রেলের লাগেজ ভ্যানের সংকট ছিল। ফলে মানুষ অন্য সার্ভিসের দিকে ঝুঁকেছে। এখন লাগেজ ভ্যানে পণ্য আনতে কয়েকবার গাড়ি পরিবর্তন করতে হয়, যেখানে ট্রাক ডোর-টু-ডোর সেবা দিচ্ছে।"
"তাছাড়া অনেক মেইল ও লোকাল ট্রেনই বন্ধ আছে রোলিং স্টকের সংকটে। তাই লাগেজ ভ্যানের ব্যবহার কমেছে," যোগ করেন তিনি।
ইজারা বা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা
বর্তমানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ লাগেজ ভ্যান পরিচালনার দায়িত্ব বেসরকারি খাতে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। গত ৫ জানুয়ারি রেলের এক সভায় 'বাংলাদেশ রেলওয়ের মাধ্যমে ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের (বেসরকারি) পার্সেল ও গুডস পরিবহন নীতিমালা ২০২৪' খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সভায় জানানো হয়, রেলের মোট লাগেজ ভ্যানের মাত্র ৫ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। ইজারা বা ভাড়ার ভিত্তিতে পরিচালনার মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব হবে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, "লাগেজ ভ্যানগুলো মূলত মেইল ও লোকাল ট্রেনে চলত। রোলিং স্টক সংকটে সেসব ট্রেনের অনেকগুলো এখন বন্ধ।"
"ভ্যানগুলোর ব্যবহার ও আয় বাড়াতে আমরা কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করছি। এছাড়া, ডাক বিভাগের সঙ্গেও কথা হচ্ছে। তবে তাদের ভাড়া হার অনেক পুরোনো, তাই তা পুনঃনির্ধারণ করতে বলা হয়েছে," যোগ করেন তিনি।