লোকোমোটিভ সংকটে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকায় কনটেইনার পরিবহনে স্থবির অবস্থা

রেলওয়েতে তীব্র লোকোমোটিভ সংকট দেখা দেওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকায় কনটেইনার পরিবহন কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। বন্দরের ইয়ার্ডে আটকে আছে ১,২০০ এরও বেশি টিইইউ কনটেইনার।
রেলওয়ের ১৭ আগস্টের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটে কনটেইনার ও তেলবাহী ট্রেন চলাচল সচল রাখতে যেখানে ১৩টি লোকোমোটিভ প্রয়োজন, সেখানে কার্যত চলছে মাত্র দুটি।
একটি ইঞ্জিন দেওয়া হয়েছে কনটেইনারবাহী ট্রেনে এবং অন্যটি বিশেষ সেনা সেবায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে বন্দরে ও আশপাশের স্টেশনে অন্তত আটটি পূর্ণ কনটেইনার রেক থেমে আছে কোনো ইঞ্জিন ছাড়াই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু রেক ১০ আগস্ট থেকে আটকে আছে। অর্থাৎ এক সপ্তাহেরও বেশি সময় আগে লোড করা কনটেইনারগুলো এখনও নড়েনি। সব মিলিয়ে বন্দরের ইয়ার্ডে আটকে আছে ১,২৩৪ টিইইউ কনটেইনার।
রেলওয়ে ও বন্দরসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম বন্দর সচল রাখতে প্রতিদিন অন্তত ৬টি কনটেইনার ট্রেন প্রয়োজন—চট্টগ্রাম ও ঢাকার মধ্যে ৩টি করে। কিন্তু লোকোমোটিভের সংকটে বর্তমানে উভি দিকে ২টি করে মাত্র ৪টি ট্রেন চলাচল করছে।
লোকোমোটিভ সংকটে শুধু কনটেইনার নয়, তেলবাহী ট্যাংক ওয়াগন ও সাধারণ মালবাহী রেকও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে বাতিল করতে হয়েছে একাধিক ট্রেন। শুধু ২০ আগস্টেই লোকোমোটিভের অভাবে রপ্তানি পণ্য পরিবহনের জন্য নির্ধারিত দুটি কনটেইনার ট্রেন বাতিল হয়। এতে বন্দরের ভেতরে জট আরও বেড়েছে এবং কমলাপুর আইসিডিতে পণ্য পাঠাতে দেরি হচ্ছে।
আর এই জটের প্রভাব পড়ছে সবখানে—কনটেইনার খালাস ধীরগতিতে হওয়ায় ইয়ার্ডে জায়গার সংকট দেখা দিয়েছে, যা জাহাজ থেকে মাল খালাস ও কনটেইনার স্তূপীকরণ কার্যক্রমকেও মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।

বন্দরের উন্নয়ন হলেও রেল পিছিয়ে
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) সম্প্রতি ইয়ার্ড সম্প্রসারণ ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির বড় পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। গত এক বছরে সিপিএ পুরোনো অকশন ইয়ার্ড, গাড়ি সংরক্ষণ এলাকা, ব্যাগেজ শেড এবং এক্স ও ওয়াই শেড সংস্কার এবং নতুন ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শেষ করেছে।
কিন্তু এই উন্নয়ন কাজের মধ্যেই রেলওয়ের লোকোমোটিভ সংকট কনটেইনার পরিবহনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮ টিইইউ থেকে বেড়ে প্রায় ৫৯ হাজার টিইইউতে পৌঁছেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক ২১ আগস্ট এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, 'অতিরিক্ত জায়গার ফলে এখন নির্বিঘ্নে ৪৭ থেকে ৪৮ হাজার টিইইউ কনটেইনার খালাস করা সম্ভব।'
তিনি আরও জানান, জাহাজ থেকে পণ্য খালাস কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। প্রতিদিন ১০টি কনটেইনার জাহাজ খালাস করা হলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২-১৩টিতে। জাহাজের টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম নেমে এসেছে মাত্র ২ দশমিক ৫৮ দিনে।
"আউটার অ্যানকরেজে থাকা জাহাজগুলো এখন সর্বোচ্চ দুই দিন বা অনেক সময় একেবারেই অপেক্ষা না করেই বার্থিং সুবিধা পাচ্ছে," বলেন তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) আশা করছে, চলমান ইয়ার্ড নির্মাণকাজ শেষ হলে এ বছরের শেষ নাগাদ মোট ধারণক্ষমতা বেড়ে ৬২ হাজার টিইইউতে পৌঁছাবে।
তবে রেলের সহায়তা না পেলে এ সাফল্য বিফল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে বন্দরে প্রায় ১২ হাজার কনটেইনার অচল অবস্থায় পড়ে আছে—যার মধ্যে ১০ হাজার নিলামের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ২,০০০ ঢাকার আইসিডিতে পাঠানোর অপেক্ষায় রয়েছে। দেশের ব্যস্ততম এ সমুদ্রবন্দরে এই কনটেইনারের চাপ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তিতে।
স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষ ও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, রেলের এই সংকট অব্যাহত থাকলে বন্দরে ইয়ার্ডজট আরও তীব্র হবে এবং লজিস্টিক খরচ বেড়ে যাবে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে, আমদানিকারকদেরও বাড়তি ডেলিভারি চার্জ ও দীর্ঘ বিলম্বের মুখে পড়তে হবে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দামে প্রভাব ফেলবে।
ব্যবসায়ীদের শঙ্কা
রপ্তানিকারকদের মতে, বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো নির্ধারিত সময়সীমা মিস হওয়া। অনেক বিদেশি ক্রেতা কঠোর সময়সূচি মেনে কাজ করেন এবং নির্ধারিত সময়ে পণ্য না পৌঁছালে জরিমানাও গুনতে হয়।
রপ্তানিকারক বেলায়েত হোসেন বলেন, "কয়েক দিনের দেরিতেই অর্ডার বাতিল হতে পারে। দ্রুত লোকোমোটিভ সরবরাহ না করা হলে আমাদের রপ্তানিকারকদের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।"
আমদানিকারকদেরও উদ্বেগ বাড়ছে। কনটেইনারগুলো বন্দরের ইয়ার্ডে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দিন পড়ে থাকায় তাদের অতিরিক্ত গুদাম ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
শিল্প কাঁচামালের আমদানিকারক শহিদুল ইসলাম বলেন, "এক একটা বাড়তি দিনে জন্য অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। এটা পূর্ণাঙ্গ সংকটে পরিণত হওয়ার আগেই রেলওয়েকে ব্যবস্থা নিতে হবে।"
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অতিরিক্ত লোকোমোটিভ চালু করা জরুরি। আর দীর্ঘমেয়াদে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে—যা বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি বৈদেশিক বাণিজ্য সামলায়—বাংলাদেশ রেলওয়েকে লোকোমোটিভ বহর বৃদ্ধি ও রক্ষণাবেক্ষণ সক্ষমতায় আরও জোর দিতে হবে।
বিষয়টি স্বীকার করে রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলেন, লোকোমোটিভ সংকট দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ ঘাটতির ফল। নিয়মিত মেরামতের জন্য অনেক ইঞ্জিন সার্ভিস থেকে বাদ পড়ায় চট্টগ্রাম–ঢাকা করিডরে—যেখানে দেশের বেশিরভাগ কনটেইনার পরিবহন হয়—চাহিদা মেটানোর মতো ইঞ্জিন থাকছে না।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সুবক্তগীন জানিয়েছেন, এ সপ্তাহেই বন্দরের কনটেইনার পরিবহনের জন্য আরও দুটি ইঞ্জিন যোগ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, "বছর শেষের আগেই নতুন কয়েকটি ইঞ্জিন আসবে। আমরা আশাবাদী, শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে।"