লোকোমোটিভ সংকটে কমছে রেলওয়ের লাভজনক পণ্য পরিবহন সেবা
বাংলাদেশ রেলওয়ের লাভজনক মালবাহী পরিবহন খাত দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। কার্যকর লোকোমোটিভের তীব্র সংকটের কারণে একের পর এক গ্রাহক ও রাজস্ব হারাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত ইঞ্জিন না থাকায় মালবাহী ট্রেন কমিয়ে আনা হয়েছে। ফলে তুলনামূলক সাশ্রয়ী ও নিরাপদ এ পরিবহন ব্যবস্থার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গ্রাহকরা।
কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, দেশের আমদানি-রপ্তানির প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আগে একমাসে ১২০টির বেশি কনটেইনার ট্রেন ঢাকার পথে চলাচল করত। তবে বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫০-৬০টিতে—অর্থাৎ, অর্ধেকেরও নিচে।
কমছে সেবাদান
রেলওয়ের হিসাব বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪,২৭৩টি পণ্যবাহী ট্রেন চলেছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে ৩,৩৮৭টিতে দাঁড়ায়। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে সার্ভিস দিয়েছে ২,২৮৫টি ট্রেন। এর মধ্যে কনটেইনার পরিবহন হয়েছে ১,১৭৫টিতে, জ্বালানি ৮৮১টিতে এবং খাদ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সার্ভিস দিয়েছে ২৯টি ট্রেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. শহিদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যাত্রী পরিবহনে ভর্তুকি দিতে হয়, তবে পণ্য পরিবহন খাত লাভজনক। কিন্তু ইঞ্জিন সংকটের কারণে ট্রেন সংখ্যা কমাতে হচ্ছে। অনেক সময় যাত্রীবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হলে পণ্যবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন সরিয়ে সেখানে দিতে হয়, এতে পণ্য পৌঁছাতে দেরি হয়।"
লোকোমোটিভের তীব্র সংকট
বর্তমানে রেলওয়ের বহরে ২৮১টি লোকোমোটিভ থাকলেও এর মধ্যে প্রায় ৯০টি অচল। অধিকাংশ ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ায় ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানান।
তথ্য অনুযায়ী, প্রশাসনিক দুই জোনের—পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল—মধ্যে ৯৫ শতাংশের বেশি পণ্য পরিবহন পূর্বাঞ্চল দিয়ে হয়। পশ্চিম জোনে ১৫০টির মধ্যে ৩৯টি এবং পূর্ব জোনে ১৩১টির মধ্যে ৫৫টি লোকোমোটিভ অকেজো অবস্থায় রয়েছে। ফলে মালবাহী সার্ভিসে পড়ছে বড় প্রভাব।
চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই) সূত্র বলছে, জ্বালানি, পাথর, খাদ্যশস্য ও শিল্প কাঁচামালের পরিবহনের জন্য কমপক্ষে ১৫টি লোকোমোটিভ প্রয়োজন। বর্তমানে সেখানে নিয়মিত মেলে মাত্র ৫-৬টি। শুধু কনটেইনারবাহী ট্রেন পরিচালনার জন্য ৭টি ইঞ্জিনের প্রয়োজন হলেও, এর বিপরীতে সিজিপিওয়াই পাচ্ছে মাত্র এক-দুটি।
শিল্পখাতে নেতিবাচক প্রভাব
রেল ইঞ্জিন সংকটে বড় শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পণ্য পরিবহনে দেরি হওয়ায় এ সংক্রান্ত ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আগে কনটেইনার সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করতে হতো দুই দিন। এখন সেই সময় বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক সপ্তাহে।
বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "চাহিদা অনুযায়ী ট্রেন না চলায় বন্দর থেকে মাল খালাসে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিচ্ছে। এতে আমদানি-রপ্তানিকারকদের অতিরিক্ত পোর্ট চার্জ বহন করতে হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে পণ্য পরিবহন সম্ভব হচ্ছে না।"
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পরিচালক (অপারেশন ও পরিবহন) ড. একেএম আজাদুর রহমান বলেন, "জ্বালানি পরিবহনে রেলপথ নিরাপদ ও সাশ্রয়ী। একটি ওয়াগনে বেশি পরিমাণ জ্বালানি বহন করা যায়, অপচয়ও কম হয়। তবু ইঞ্জিন সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে নৌপথের পাশাপাশি সড়কপথেও ট্যাংকারে জ্বালানি পরিবহন হচ্ছে; এতে ব্যয় বেড়েছে।"
এদিকে লোকোমোটিভ ও ওয়াগনের সংকটে রেলপথে সার পরিবহনও বন্ধ রয়েছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সড়কপথে পণ্য পরিবহন করতে হচ্ছে—যা ব্যয় বড়াচ্ছে।
রেলখাতে বিনিয়োগ
তথ্যমতে, ২০০৯ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত রেলওয়ের ১২১টি প্রকল্পে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। নতুন রেললাইন নির্মাণ হয়েছে ৯৪৮ কিলোমিটার। কিন্তু এই সময়ে নতুন লোকোমোটিভ কেনা হয়েছে মাত্র ৪০টি।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সুবক্তগীন বলেন, "দীর্ঘদিন ইঞ্জিন আমদানি না হওয়ায় সংকট তীব্র হয়েছে। যাত্রীবাহী ট্রেনের টিকিট আগেই বিক্রি হওয়ায় সেগুলো বাতিল করা কঠিন, ফলে মালবাহী ট্রেন পিছিয়ে দিতে হয়।"
"তবে রেলওয়ে মেরামতের কাজ বাড়িয়েছে এবং নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে ইঞ্জিন আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। এসব বাস্তবায়ন হলে পণ্যবাহী ট্রেন সেবা স্বাভাবিক হবে," যোগ করেন তিনি।
