১ হাজার কি.মি. নতুন রেলপথ, ৮৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়; তবু ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণে হিমশিম দশা রেলওয়ের

বাংলাদেশে রেলওয়ে খাতে গত ১৫ বছরে ৮৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় এবং প্রায় এক হাজার কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এই বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও রেলওয়ে এখনো ইঞ্জিন বা লোকোমোটিভ রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে মারাত্মক সংকটে। ইঞ্জিনগুলো এত দ্রুত বিকল হয়ে পড়ছে যে, সেগুলো মেরামত করে সচল রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী—সর্বত্র যাত্রীরা প্রতিদিন বিলম্ব আর ট্রেন বাতিলের ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। আর পণ্যবাহী ট্রেন বা ফ্রেইট সার্ভিস—যা একসময় দেশের সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রধান ভরসা ছিল—প্রায় তলানিতে নেমেছে। ফলে পণ্যবাহী কনেটেইনার বন্দরের ইয়ার্ডে আটক পড়ে জট সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই জোনে বিভক্ত। বর্তমানে রেলওয়ের বহরে মোট ২৮১টি লোকোমোটিভ থাকলেও ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৪টি ইঞ্জিন অচল হয়ে থাকার কথা জানা গেছে। এরমধ্যে পশ্চিম জোনে ১৫০টি লোকোমোটিভের ৩৯টি এবং পূর্ব জোনে ১৩১টির মধ্যে ৫৫টি চলাচলের বাইরে।
রেল কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, বছরের পর বছর ধরে দুর্বল পরিকল্পনা, যন্ত্রাংশ সংকট এবং দীর্ঘদিনের অবহেলাই আজকের এই দুরবস্থার কারণ। রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, "ইঞ্জিনগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। নতুন আমদানি করা ইঞ্জিনগুলো অত্যাধুনিক ছিল, তবে এগুলো সম্পর্কে হয়তো রেলের কারখানা সংশ্লিষ্টদের সম্যক জ্ঞান ছিল না।"
তিনি আরও বলেন, "মিটারগেজের ইঞ্জিন বিশ্বব্যাপী কম চলে। এগুলোর যন্ত্রাংশ সহজে পাওয়া যায় না। এছাড়া দরপত্র প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। এসব বিবেচনায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সময়মতো আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গাফিলতিও ছিল। ফলে এখন সংকট বেড়েছে। বেশিরভাগ ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল অনেক আগে পেরিয়েছে। ৫০-৬০ বছরের পুরনো ইঞ্জিনও চলছে। আরো আগেই ইঞ্জিন আমদানির উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল।"

দিশাহীন সম্প্রসারণ
২০০৯ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত রেলওয়ের ১২১টি প্রকল্পে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা, যার মাধ্যমে ৯৪৮ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কেনা হয় মাত্র ৪০টি নতুন ইঞ্জিন।
অন্যদিকে, ৯০টিরও বেশি পুরনো লোকোমোটিভ—যার কিছু অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলছিল—পরিচালনা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৭০টি ইঞ্জিন ক্রয় প্রকল্প ১৪ বছর ঝুলে থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে না পেরে গত বছর বাতিল করা হয়েছে। এদিকে গত দেড় দশক ধরেই বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনছে।
রেলওয়ের পরিবহন ও যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের হিসাবে, সব ট্রেন চালাতে অন্তত ৩,০০০ কোচ ও ৩০০ লোকোমোটিভ প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে রেলওয়েতে আছে ২,৫০০ কোচ ও ৩০০ লোকোমোটিভের কিছু বেশি, যার সবগুলো কার্যকর নয়। ৫০ শতাংশেরও বেশি ইঞ্জিন ও কোচ কার্যকর মেয়াদ বা সার্ভিস লাইফ অতিক্রম করেছে। বর্তমানে কার্যকর অবস্থায় আছে মাত্র প্রায় ২,০০০ কোচ ও ২০০-এর কিছু বেশি লোকোমোটিভ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক টিবিএসকে বলেন, "অপরিকল্পিত বিনিয়োগের কারণে রেলওয়ের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো প্রকৃত কোনো ফল আনতে পারেনি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ মুখে মুখে সুন্দর সুন্দর উপযোগিতার কথা বলত। কিন্তু তারা জানত যে, নতুন ট্র্যাক থাকলেও – কোচ ও ইঞ্জিনের অভাবে ট্রেন চালানো সম্ভব হবে না। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই।"
চট্টগ্রামে অচল অর্ধেকের বেশি ইঞ্জিন
লোকোমোটিভের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে চট্টগ্রামে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ইঞ্জিনের সংখ্যা ৮৯টি। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ না থাকায়, সময়মতো যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করার উদ্যোগ না নেওয়ায় ৪৪টি ইঞ্জিনই বিকল অবস্থায় পড়ে আছে। এরমধ্যে রয়েছে চার বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমদানি করা ৩০টি ইঞ্জিনের অর্ধেক সংখ্যক। গত আগস্টেই এগুলোর ওয়ারেন্টি শেষ হলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আনা হয়নি।
এছাড়া, চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড থেকে জ্বালানি তেল, পাথর, খাদ্যশস্য ও শিল্প কাঁচামাল পরিবহনের জন্য ১৫টি লোকোমোটিভ প্রয়োজন হলেও মাত্র সাতটি ইঞ্জিন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। কনটেইনার ট্রেনের জন্য সাতটি ইঞ্জিন দরকার থাকলেও মাত্র দুটি ইঞ্জিন চালু রয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, "ডিপো খালি করতে প্রতিদিন অন্তত চারটি মালবাহী ট্রেন দরকার, অথচ চলছে একটি বা দুটি। এখন এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ডেলিভারিতে ১৫–২০ দিন লেগে যাচ্ছে, এতে আমদানি ও রপ্তানিকারক উভয়েরই খরচ বাড়ছে।"
রেলওয়ের বিভাগীয় প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) মো. বেলাল সরকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কিছুটা কম পাওয়া যায়। আর এসব যন্ত্রাংশ আমদানি প্রক্রিয়াও দীর্ঘ। দরপত্রের পর এগুলো অর্ডার দিলে তৈরি করা হয়। বর্তমানে ধাপে ধাপে আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।"
শুধু যন্ত্রাংশ নয়, রেলের কারখানাগুলোতে তীব্র লোকবল সংকটও রয়েছে। সৈয়দপুর ও পাহারতলীর কারখানায় অনুমোদিত টেকনিক্যাল পদের সংখ্যা ৪,৮০০ হলেও, কর্মরত আছেন এর মাত্র ৪০ শতাংশ।
ঘন ঘন বিকল হয়ে পড়ছে ইঞ্জিন
তবে রেলওয়ের দুর্বল ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী রেলপথের যাত্রীরাই। গত ১৮ মে ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেনটির কক্সবাজার থেকে ফিরতি যাত্রা বাতিল করতে হয়।
৩০ জুলাই প্রবাল এক্সপ্রেস রামুর কাছে বিকল হয়ে চার ঘণ্টা আটকে থাকে, এতে পর্যটকরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। ১৪ জুন ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেস ঢাকা–সিলেট রুটে বিকল হয়ে পড়লে– আরও আটটি ট্রেনের চলাচল দুই ঘণ্টার বেশি বিলম্বিত হয়।
শুধু রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলেই জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত অন্তত ১৫০ বার ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
কক্সবাজারে একটি এনজিওতে কর্মরত শিহাব জিশান আনিক টিবিএস'কে বলেন, "এখন কক্সবাজারের ট্রেন প্রায় নিয়মিত দেরি করে ছাড়ছে, অন্তত ১৫ মিনিট দেরি তো হয়ই।"
বাংলাদেশ রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, "কক্সবাজারের মতো লাভজনক রুটও আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। যাত্রীবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হলে অনেক সময় পণ্যবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন পাঠিয়ে বাকি পথ পার করা হয়। এক্ষেত্রে পণ্য পৌঁছানোর সময়ও বাড়ছে।"