রেজ হাউস: পয়সা খরচ করে ভাঙচুর করা যায় যেখানে!

আমার কাছে মেজাজ খারাপের তিনটা ধরন আছে—মেজাজ খারাপ, খুব বেশি মেজাজ খারাপ, আর ভাঙচুর মার্কা মেজাজ খারাপ! প্রথম দুইটা কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও শেষেরটা একেবারেই কঠিন। ভাঙচুর মার্কা রাগ উঠলে সামনে যা পড়ে, তাই ভেঙে চুরমার করে দিতে মন চায়। আমরা সবাই এমন কারও না কারও সঙ্গে পরিচিত, যার রাগ উঠলে সে জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করে। আবার অনেকের নিজের মধ্যেও এমন রাগ রয়েছে।
তবে সবসময় তো রাগ উঠলেই কিছু একটা ভাঙা যায় না। এতে আর্থিক ক্ষতি হতে পারে, আহত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে। তাই যাদের রাগ বেশি, তাদের সেই রাগ নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকাশের একটা উপায় দরকার। ঠিক এই জায়গা থেকেই বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে 'দ্য রেজ হাউস'। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়—'রাগ প্রকাশের ঘর'।

এই রেজ হাউসে এসে যে কেউ মন খুলে ভাঙচুর করতে পারেন। এখানে ভাঙার জন্য জিনিসপত্রও সরবরাহ করা হয়, দেওয়া হয় ভাঙচুরের উপযোগী বিভিন্ন যন্ত্র। ঢাকার ধানমন্ডিতে চালু হওয়া এই রেজ হাউসের প্রতিষ্ঠাতা দুই বন্ধু—ফারহান ও জুবায়ের।
জাপান থেকে শুরু
রেজ হাউসের ধারণা প্রথম এসেছে জাপান থেকে। ২০০০ সালের দিকে জাপানিজরা এমন এক ঘর চালু করে, যেখানে রাগ-ক্ষোভ মেটানো যায় নিজের বা অন্য কারও ক্ষতি না করে। ধীরে ধীরে এটি একধরনের ব্যতিক্রমধর্মী বিনোদনেও পরিণত হয়। অনেকেই বন্ধু-বান্ধব বা সহকর্মীদের নিয়ে দলবেঁধে রেজ হাউসে যান।
জাপান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। দিনকে দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই রেজ হাউস সংস্কৃতি। এর বিশেষত্ব হলো—নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে যা খুশি, তা করা যায়। কেউ প্রশ্ন করবে না, বিচার করবে না, অপরাধবোধে ভুগতেও হবে না। শুধু মনের ভেতর জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ আর হতাশা উগরে দেওয়া যাবে।

রেজ হাউস অনেকটা মানসিক চাপ মুক্তির একটি কৌশল হিসেবেও কাজ করে। রাগ ও চাপের সময়ে আমাদের দেহে কর্টিসল নামের এক হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। শরীরচর্চা বা উচ্চমাত্রার শারীরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে সেই কর্টিসলের মাত্রা কমানো সম্ভব হয়। রেজ হাউস সেই কাজটাই করে। এখানে ভাঙচুর করতে করতে কেউ চিৎকার করলেও সমস্যা নেই—ঘরটি সাউন্ডপ্রুফ। বাইরে কেউ কিছুই শুনবে না।
এখানে কাঁচের জিনিস ভাঙা হয় সবচেয়ে বেশি। তবে বিদেশের অনেক রেজ হাউসে টিভি, ল্যাপটপ, ফ্রিজ, ওভেনের মতো জিনিসও ভাঙার জন্য রাখা হয়। এমনকি, আমেরিকার কিছু রেজ হাউসে ম্যানিকুইনও থাকে। কেউ যদি কোনো ব্যক্তির ওপর রাগ পোষণ করে, তাহলে ম্যানিকুইনকে সেই ব্যক্তির জায়গায় কল্পনা করে পিটিয়েও আসতে পারেন।

দেশের প্রথম রেজ হাউসের গল্প
ফারহান আহমেদ একদিন তার প্রেমিকার সঙ্গে একটি ডিনারে যান। খাওয়া-দাওয়া শেষে তারা জীবনের নানা সমস্যা ও হতাশা নিয়ে কথা বলছিলেন। সেইসময় তার প্রেমিকা হঠাৎ ফেসবুকে একটি রিল দেখান—একটি বিদেশি রেজ হাউসের ভিডিও, যেখানে মানুষ টাকা খরচ করে ভাঙচুর করে মনের রাগ ও হতাশা দূর করছে। ভিডিওটি দেখে ফারহান ভেবেছিলেন তিনিও এমন একটি রেজ হাউসে যাবেন। কিন্তু ঢাকায় বা বাংলাদেশের কোথাও এমন কোনো জায়গার অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না। তখনই তার মাথায় আসে নিজেই এমন একটি রেজ হাউস চালুর চিন্তা। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করলে তারাও এতে আগ্রহ দেখান।
সব মিলিয়ে এ বছরের ১৮ জুলাই 'দ্য রেজ হাউস'-এর যাত্রা শুরু হয়। এখনো এটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। ফারহান জানান, তাদের লক্ষ্য একটি নিরাপদ স্থান তৈরি করা, যেখানে মানুষ স্বাস্থ্যকর উপায়ে রাগ ও হতাশা প্রকাশ করতে পারবে—নিজের বা অন্য কারও ক্ষতি না করেই। এক মাস পার না হতেই দ্য রেজ হাউস অভাবনীয় সাড়া পেয়েছে। প্রথম দশ দিনেই অনেকে একাধিকবার এসেছেন। কেউ এসেছেন বন্ধু, কেউ আত্মীয় নিয়ে। এমনকি, একজন মা তার দুই সন্তানকেও নিয়ে এসেছিলেন।

যা যা করা যায়
দেশের প্রথম রেজ হাউস শুরুর পর থেকেই দর্শনার্থীরা দারুণ সাড়া দিচ্ছেন। এখানে নির্দিষ্ট সময় ধরে ভাঙচুর করার সুযোগ দেওয়া হয়; পুরনো টিভি, মনিটর, কিবোর্ড, কাঁচের বোতল, মাটির পাত্র ইত্যাদি ভাঙা যায়। এসব সরবরাহ করা হয় স্থানীয় ভাঙারি দোকান থেকে। আর ভাঙার জন্য ব্যবহার করা যায় বেসবল ব্যাট, গলফ ক্লাব কিংবা হকি স্টিক—যেকোনো একটি বেছে নেওয়া যায়।
এখানে ভাঙচুরের জন্য তিন ধরনের প্যাকেজ রাখা হয়েছে। প্রথম প্যাকেজের দাম ৬০০ টাকা। এই প্যাকেজ একজনের জন্য। সময় পাওয়া যায় ১০ মিনিট। ভাঙার জন্য দেওয়া হয় ৩টি কাঁচের বোতল, ৪টি মাটির পাত্র আর ১টি কি-বোর্ড।
পরের প্যাকেজে দুইজন যাওয়া যায় রেজ রুমের ভেতরে। সময় দেওয়া হয় ১৫ মিনিট। আর ভাঙার জন্য থাকে ৬টি করে কাঁচের বোতল ও মাটির পাত্র, ২টি কি-বোর্ড আর ১টি মাঝারি আকারের টিভি। এই প্যাকেজের জন্য গুনতে হবে ১০৯৯ টাকা।

তৃতীয় প্যাকেজ তিনজনের জন্য। এতে সময় দেওয়া হয় ২০ মিনিট। সবচেয়ে বেশি জিনিসপত্র ভাঙচুর করা যায় এই প্যাকেজে। ১০টি করে কাঁচের বোতল আর মাটির পাত্র, ৪টি কি-বোর্ড, ১টি বড় টিভি আর ১টি ছোট টিভি থাকে রুমের ভেতরে। এই প্যাকেজের দাম ১,৬০০ টাকা। তিনজনের বেশি লোক নিতে চাইলে জনপ্রতি দিতে হবে আরও ৫০০ টাকা করে।
দ্য রেজ হাউসে রয়েছে তিনটি রেজ রুম, প্রতিটিই সাউন্ডপ্রুফ। অর্থাৎ, ভেতরের শব্দ বাইরে যাবে না। রুমগুলোতে এসি আছে, তবে তা শুধু শীতল রাখার জন্য—ভাঙার জন্য নয়! ঘরগুলো সাজানো হয়েছে উজ্জ্বল রঙের পাংক থিমের গ্রাফিতি ও নিয়ন লাইটিং দিয়ে, যাতে এক ধরনের থেরাপিউটিক পরিবেশ তৈরি হয়। কেউ কেউ এখন কেবল রাগ প্রশমন নয়, ব্যতিক্রমধর্মী বিনোদনের আমেজ নিতে এসেও সময় কাটাচ্ছেন এখানে।
সবার আগে নিরাপত্তা
নিরাপত্তা দ্য রেজ হাউসের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ১৬ বছরের নিচের কাউকে রেজ রুমে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কেউ মাদক গ্রহণ করে থাকলে কিংবা অসুস্থ হলে তাকে রেজ রুমে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। ব্যক্তিগত কোনো জিনিস ভাঙার জন্য সঙ্গে আনা নিষিদ্ধ—শুধু কর্তৃপক্ষ যা দেবে, তা-ই ভাঙতে হবে। প্রতিটি সেশনের আগে একজন পেশাদার সেফটি অফিসার গ্রাহকদের নিরাপত্তাবিষয়ক নির্দেশনা দেন।

যেহেতু এখানে বেশিরভাগ সময় কাঁচের জিনিস ভাঙা হয়, তাই নিরাপত্তা সরঞ্জাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অংশগ্রহণকারীদের দেওয়া হয় ফুল বডি কভার, হেলমেট, সেফটি গগলস, মোটা কাঁচের নিরাপত্তা মাস্ক, বুট, গ্লাভস ও নয়েজ ক্যানসেলিং হেডফোন—যাতে উচ্চ শব্দে কান ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এসব সুরক্ষা সরঞ্জাম প্রতিটি প্যাকেজের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। কেউ যদি ভাঙচুর করতে গিয়ে সামান্য আঘাত পান, তার জন্য আছে প্রশিক্ষিত কর্মীদের দ্বারা তাৎক্ষণিক ফার্স্ট এইড সেবা।
ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত