দেশভাগের পর পাকিস্তানে ফিরছে সংস্কৃত ভাষা, রয়েছে গীতা-মহাভারত নিয়ে গবেষণার পরিকল্পনাও
দেশভাগের পর এই প্রথমবার পাকিস্তানের কোনো শ্রেণিকক্ষে ফিরছে সংস্কৃত ভাষা। লাহোর ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস (এলইউএমএস) ক্লাসিক্যাল এই ভাষার উপর চার ক্রেডিটের একটি কোর্স চালু করেছে বলে জানা গেছে। এটি দেশটির জন্য সংস্কৃতচর্চা পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে একটি বিরল প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ।
সংস্কৃতের উপর পুনরায় গুরুত্ব দেওয়ার উদ্যোগ মূলত ফরমান খ্রিষ্টান কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহীদ রশীদের প্রচেষ্টার ফসল। তিনি বছরের পর বছর ধরে এই ভাষাটি নিয়ে গবেষণা করেছেন।
ড. রশীদ দ্য ট্রিবিউনকে বলেন, "ক্লাসিক্যাল ভাষাগুলোতে মানবজাতির জন্য প্রচুর জ্ঞান রয়েছে। আমি আরবি এবং ফার্সি শেখা শুরু করেছিলাম, এরপর সংস্কৃত অধ্যয়ন করি।" তিনি আরও বলেন, তার শেখার বেশিরভাগটাই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এসেছে।
তিনি বলেন, "ক্লাসিক্যাল সংস্কৃত ব্যাকরণ শিখতে আমার প্রায় এক বছর সময় লেগেছিল। এবং আমি এখনও তা শিখছি।"
তিন মাসের একটি সাপ্তাহিক কর্মশালা থেকে এর যাত্রা শুরু হয়। সেসময় কোর্সটির প্রতি শিক্ষার্থী ও গবেষকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছিল।
এলইউএমএস-এর গুরুমানি সেন্টারের পরিচালক ড. আলী উসমান কাসমি বলেন, এই অঞ্চলে সংস্কৃতের যে সংগ্রহ রয়েছে, তার মধ্যে পাকিস্তানের সংগ্রহ অন্যতম ও সমৃদ্ধ। কিন্তু এখানেই এসব সবচেয়ে কম-আলোচিত হয়েছে। 'দ্য ট্রিবিউন'-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত তালপাতার পাণ্ডুলিপির বিশাল ভান্ডারের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, "১৯৩০-এর দশকে পণ্ডিত জেসিআর উলনার তালপাতায় লেখা সংস্কৃত ভাষার একটি পাণ্ডুলিপির উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ তালিকাভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর থেকে কোনো পাকিস্তানি শিক্ষাবিদ এই সংগ্রহ নিয়ে কাজ করেননি। শুধুমাত্র বিদেশী গবেষকরা এটি ব্যবহার করেন। স্থানীয়ভাবে গবেষকদের প্রশিক্ষণ দিলে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।"
'এটি আমাদেরও'
যেহেতু সংস্কৃত ভাষা সাধারণত হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থের সাথে সম্পর্কিত, তাই এই ভাষাটি বেছে নেওয়ায় ড. রশীদকে প্রায়শই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।
তিনি ইংরেজি দৈনিককে বলেন, "আমি তাদের বলি, কেন আমরা এটি শিখব না? এটি সমগ্র অঞ্চলের একটি সেতুবন্ধনকারী ভাষা। সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পাণিনির গ্রাম এই এলাকাতেই ছিল। সিন্ধু সভ্যতার সময় এখানে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। সংস্কৃত একটি পাহাড়ের মতো—এটি একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আমাদের এটিকে আপন করে নিতে হবে। এটি আমাদেরও; এটি কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মের সঙ্গে আবদ্ধ নয়।"
রশীদ মনে করেন, বিভিন্ন দেশের মধ্যে ক্লাসিক্যাল ভাষাগুলোর ব্যাপক চর্চা আঞ্চলিক সম্পর্ককে পরিবর্তন করে দিতে পারে। তিনি বলেন, "একবার ভাবুন, যদি ভারতে আরও বেশি সংখ্যক হিন্দু ও শিখ আরবি শেখা শুরু করেন এবং পাকিস্তানে আরও বেশি মুসলমান সংস্কৃত শেখেন, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি নতুন, আশার আলো দেখাতে পারে, যেখানে ভাষাগুলো আর বিভেদ তৈরি না করে বরং সেতু হিসেবে কাজ করবে।"
ভাষা যখন সেতু, সীমানা নয়
'দ্য প্রিন্ট' কর্তৃক প্রকাশিত একটি পৃথক প্রতিবেদনে ড. রশীদের ব্যক্তিগত যাত্রার একটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। ৫২ বছর বয়সী এই শিক্ষাবিদের কাছে ভাষা হলো একটি "সেতু", যা একটি অভিন্ন ইতিহাসে গ্রথিত এবং যা শুরু হয়েছে তার নিজের বাড়ি থেকেই। তার প্রথম ছাত্রী ছিলেন তার নিজের মেয়ে, যিনি এখন দেবনাগরী লিপিতে সাবলীল।
'দ্য প্রিন্ট' জানায়, যখন রশীদের এক দাদী বর্তমান উত্তর প্রদেশের শেখপুরা থেকে তার কাছে বেড়াতে আসেন, তিনি তার বংশের উৎস কর্নালের একটি গ্রামে খুঁজে পান। তিনি এ সংযোগগুলোকে সীমান্ত ও রাজনীতির দ্বারা বিভক্ত একটি অভিন্ন সভ্যতার স্মারক বলে মনে করেন।
তিনি স্মরণ করে বলেন, "দেবনাগরী আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। এটি এতটা শৈল্পিক যে, আমি এর গভীরতা অনুভব করেছিলাম।"
গীতা ও মহাভারতের কোর্স চালুর পরিকল্পনা
এই উদ্যোগ শুধু একটি কোর্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ড. কাসমির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের কোর্সের পরিসর বাড়িয়ে মহাভারত এবং শ্রীমদ্ ভগবদ্ গীতা নিয়ে সুনির্দিষ্ট অধ্যয়ন অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করেছে।
তিনি দ্য ট্রিবিউনকে বলেন, "আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে, আমরা পাকিস্তানে বসেই গীতা এবং মহাভারতের গবেষক তৈরি হতে দেখবো।"
সংস্কৃত প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে, শিক্ষার্থীদের সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপকরণের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিজ 'মহাভারত'-এর বিখ্যাত থিম গান "হ্যায় কথা সংগ্রাম কি"-এর উর্দু অনুবাদ।
