রুশ আক্রমণে ব্যাপক ক্ষতি, যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাচ্ছে রেকর্ড সংখ্যক ইউক্রেনীয় সৈন্য
টিমোফির হাতের তালু আর আঙুলে এখনো সেই ক্ষত দগদগে। কাঁটাতারের বেড়ার আঁচড়। হালকা বেগুনি রঙের সেই দাগগুলো মনে করিয়ে দেয় ছয় মাস আগের এক ঘটনার কথা। সেদিন তিনি একটি সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা ট্রেনিং সেন্টারের দেয়াল টপকে পালিয়েছিলেন।
কিয়েভের ৩৬ বছর বয়সী এই অফিস কর্মী আল জাজিরাকে জানান, এপ্রিলে তাকে জোর করে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়েছিল। এরপর তিনি দুইবার পালান।
কেন পালালেন তিনি? টিমোফি জানালেন, প্রশিক্ষণ ছিল নামমাত্র। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই দায়সারা প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে নামলে তিনি নিশ্চিত মারা পড়বেন। তাকে 'স্টর্ম ট্রুপার' হিসেবে ফ্রন্ট লাইনে পাঠানো হতো, যেখানে বাঁচার আশা নেই বললেই চলে।
টিমোফি বলেন, 'প্রশিক্ষণ বলতে কিছুই নেই। প্রথম হামলাতেই যে আমি মারা যাব, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।' কিয়েভ থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর এপ্রিলে ড্রিল সার্জেন্টরা তাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল।
তার দাবি, প্রশিক্ষকদের মূল চিন্তা ছিল কেউ যেন পালিয়ে না যায়। কেন্দ্রটির চারপাশে ছিল ৩ মিটার (প্রায় ১০ ফুট) উঁচু কংক্রিটের দেয়াল, তার ওপরে কাঁটাতার।
তিনি বলেন, 'সৈনিক গুলি চালাতে শিখল কি না, তা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। আমাকে একটা বন্দুক দেওয়া হলো। আমি লক্ষ্যের দিকে এক রাউন্ড গুলি ছুড়লাম। আর তারা আমার নামের পাশে টিক চিহ্ন দিয়ে দিল।'
টিমোফি এখন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লুকিয়ে আছেন। তাই তিনি তার পুরো নাম বা পরিচয় জানাতে চাননি।
তিনি দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে দলত্যাগ বা অনুমতি ছাড়া অনুপস্থিত থাকার কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এখনো আনা হয়নি। অনলাইনে মামলার তালিকায় তার নাম নেই।
তার ব্যাখ্যা খুব সহজ: 'অর্ধেকই তো এখন পলাতক।' সবাইকে খুঁজে বের করে ধরার সাধ্য সামরিক বা বেসামরিক কর্তৃপক্ষের নেই।
পরিসংখ্যানও আঁতকে ওঠার মতো। সরকারি আইনজীবীরা গত অক্টোবরে জানিয়েছেন, ২০২২ সালে রাশিয়া পুরোদমে হামলা শুরুর পর থেকে প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার সেনা অনুমতি ছাড়া কর্মস্থল ত্যাগ করেছেন। আর দলত্যাগ করেছেন প্রায় ৫৪ হাজার। গত বছর থেকে এই সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১ লাখ ৭৬ হাজার জন কর্মস্থল ছেড়েছেন এবং ২৫ হাজার জন দলত্যাগ করেছেন।
ইউক্রেনীয় স্টর্ম ট্রুপসের কমান্ডার ভ্যালেন্টিন মানকো বলেন, 'এমনকি রাশিয়াতেও এত পলাতক সেনা নেই।'
একদিকে সেনাসংকট, অন্যদিকে রাশিয়ার অগ্রগতি—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ। গত নভেম্বরেই রুশ বাহিনী প্রায় ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছে। ওদিকে ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনাও থমকে আছে।
মানকো জানান, প্রতি মাসে প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সব ইউনিট সচল রাখতে দরকার ৭০ হাজার সেনা।
যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী, ইউনিট ছাড়ার ২৪ ঘণ্টা পার হলেই কাউকে দলত্যাগী বলা যায়। এর শাস্তি ৫ থেকে ১২ বছরের জেল। আর অনুমতি ছাড়া অনুপস্থিত থাকলে ১০ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
কিন্তু অনেকেই যুদ্ধের চেয়ে জেলকেই শ্রেয় মনে করছেন।
ইউক্রেন সেনাবাহিনীর সাবেক ডেপুটি চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইহোর রোমানেনকো আল জাজিরাকে বলেন, 'আমাদের পলাতক সেনার সংখ্যা অনেক বেশি। তারা মনে করে, ফ্রন্ট লাইনে যাওয়ার চেয়ে জেলে যাওয়া সহজ এবং নিরাপদ।'
রোমানেনকো অনেক দিন ধরেই কঠোর আইনের দাবি জানিয়ে আসছেন। তিনি মনে করেন, পলাতক ও দুর্নীতিবাজদের জেলে না পাঠিয়ে জোর করে ফ্রন্ট লাইনে পাঠানো উচিত।
তবে পরিস্থিতি সামলাতে সরকার কিছুটা নমনীয় হয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকার প্রথমবারের মতো পলাতকদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। শাস্তি ছাড়াই তারা ইউনিটে ফিরতে পারবে। প্রায় ৩০ হাজার সেনা এই সুযোগ নিয়ে ফিরেও এসেছেন।
দক্ষিণ ইউক্রেনের এক সামরিক ইউনিটের মনোবিজ্ঞানী বলেন, 'তাদের প্রতি এখন কিছুটা নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে।'
তিনি জানান, সবাই যে শুধু মৃত্যুর ভয়ে পালায়, তা নয়। অনেক সময় কমান্ডারদের অবহেলার কারণেও সেনারা পালায়।
ওই মনোবিজ্ঞানী বলেন, 'অনেকে বলেন তাদের কমান্ডার ছুটি দেয় না। অসুস্থ স্বজনদের দেখতে দেয় না। এমনকি বিয়ে করার অনুমতিও দেয় না।'
তিনি এক তরুণের উদাহরণ দেন। ওই তরুণ জানতে পেরেছিলেন তাকে পোকরভস্কের মতো বিপজ্জনক ফ্রন্ট লাইনে পাঠানো হবে। এরপরই তিনি পালিয়ে যান। পরে জানা যায়, ধরা পড়ার ঝুঁকি নিয়ে তিনি একটি কারখানায় কাজ করছেন।
এদিকে মিলিটারি পুলিশের জনবল খুবই কম। আদালতের পরোয়ানা ছাড়া তারা কাউকে আটক করতে পারে না। ওদিকে হাজার হাজার মামলা জমে থাকায় আদালতও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
পলাতকদের জন্য ভয়ের কারণ হলো 'কনস্ক্রিপশন পেট্রোল'। সেনা ও পুলিশের এই দল জনাকীর্ণ জায়গায় হানা দেয়। তারা যুদ্ধের বয়সী পুরুষদের আইডি এবং কিউআর কোডযুক্ত নথিপত্র দেখতে চায়।
তবে অনেক পলাতক জানেন কীভাবে এসব এড়াতে হয়। কেউ কেউ আবার কয়েকশ ডলার ঘুষ দিয়ে পার পেয়ে যান।
অনেক সময় পলাতকরা নিজেদের নামে নিবন্ধিত গাড়ি চালাতে গিয়ে ধরা পড়েন। এমনকি ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ট্রাফিক জরিমানা দিলেও তারা ধরা পড়ে যান।
টিমোফি এভাবেই ধরা পড়েছিলেন।
কয়েক মাস ধরে তিনি ভাইয়ের গাড়ি চালাচ্ছিলেন। কিন্তু এপ্রিলে লাল বাতি অমান্য করার জরিমানা তিনি নিজের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দেন।
কয়েক দিন পরেই ট্রাফিক পুলিশ তাকে আটক করে। পুলিশ জানায়, কয়েক মাস আগেই তাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। টিমোফি দাবি করেন, তিনি সেই নোটিশ পাননি।
তাকে ঝাইতোমির অঞ্চলের এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সেখান থেকেই তিনি পালান। কাঁটাতারের বেড়ায় একটা ফাঁক খুঁজে বের করেন। এরপর এক বন্ধুর গাড়িতে ওঠেন। গাড়ির কাছে পৌঁছাতে তাকে বৃষ্টির মধ্যে বনের ভেতর দিয়ে ৫ ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছিল। তার মুখ আর হাত ছড়ে গিয়েছিল।
টিমোফি বলেন, 'আমার বন্ধু তো আমাকে ছাড়াই প্রায় চলে যাচ্ছিল।'
কিয়েভে ফিরে তিনি বন্ধুর ফ্ল্যাটে ওঠেন। আবার কাজে যোগ দেন। এমনকি পুরোনো সিম কার্ডও ব্যবহার করতে শুরু করেন।
কিন্তু দুই মাস পর ভাইয়ের গাড়ি চালানোর সময় তিনি আবার ধরা পড়েন।
দ্বিতীয়বার পালানোটা ছিল আরও সহজ। তিনি বলেন, 'প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি ছিল কিয়েভে এবং এর দেয়ালও ছিল নিচু।' এই বলে তিনি তার ক্ষতবিক্ষত হাতের তালু দেখান।
টিমোফির বন্ধু ও আত্মীয়রা তাকে 'কাপুরুষ' ও 'দেশপ্রেমহীন' বলে ধিক্কার দিচ্ছে। তিনি অবশ্য এসব গায়ে মাখছেন না।
তিনি বলেন, 'অনেকে তো আমার সঙ্গে সম্পর্কই চুকিয়ে ফেলেছে।'
সাবেক সেনারা অবশ্য পলাতকদের একদমই সহ্য করতে পারেন না। তারা চান এদের কঠোর শাস্তি হোক এবং নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হোক।
২০২৩ সালে বাখমুতের কাছে এক চোখ হারানো ইয়েভহেন বলেন, 'এদের ভোট দেওয়ার বা পেনশন পাওয়ার কোনো অধিকার থাকা উচিত নয়।'
