ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাবের মধ্যেই ইউক্রেনের রণাঙ্গনে দুঃসংবাদ
মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধের পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকের ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগেই ভ্লাদিমির পুতিন একটি বড় দাবি করেন। তিনি জানান, কয়েক মাসের দীর্ঘ লড়াইয়ের পর তার বাহিনী কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইউক্রেনীয় শহর পোক্রভস্ক দখল করে নিয়েছে।
বাস্তবতা অবশ্য কিছুটা ঘোলাটে। যুদ্ধের মানচিত্র এবং ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর তথ্য বলছে, শহরের কিছু অংশ নিয়ে এখনো লড়াই চলছে। তবে পুতিনের এই দাবি প্রমাণ করে, তিনি পিছু হটবেন না। আলোচনার টেবিলে বসার আগে রুশ বাহিনী এখন পুরোদমে সামনের দিকে এগোচ্ছে।
ফিনল্যান্ডের ব্ল্যাক বার্ড গ্রুপের সামরিক বিশ্লেষক এমিল কাস্টহেলমি বলেন, "রাশিয়ানদের এখন পাল্লা ভারী।" তার মতে, ইউক্রেন এখনো পুরোপুরি হার মানার মতো অবস্থায় নেই। তবে তাদের এতটাই দুর্বল দেখাচ্ছে যে রাশিয়া মনে করছে তারা এখন নিজেদের শর্ত চাপিয়ে দিতে পারবে।
পুতিন তার বাহিনীকে শীতকালীন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তার কঠোর অবস্থান থেকে তিনি সরবেন না। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ মিয়ামিতে ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দুই পক্ষই একে 'গঠনমূলক' আলোচনা বলে উল্লেখ করেছে। এসব আলোচনার মধ্যেই রাশিয়া ইউক্রেনজুড়ে ৬৫০টির বেশি ড্রোন এবং ৫১টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত এই হামলা চলে।
শনিবার সন্ধ্যায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানান, তিনি উইটকফ এবং ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে দীর্ঘ ফোনালাপ করেছেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরবর্তী আলোচনার ধাপগুলো ঠিক করেছেন।
রণাঙ্গনের চিত্র
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রুশ বাহিনী বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে এগিয়ে গেছে। তারা দোনেৎস্কের পোক্রভস্ক দখলের দ্বারপ্রান্তে এবং পার্শ্ববর্তী মিরনোহরাদ প্রায় ঘিরে ফেলেছে। দক্ষিণের জাপোরিঝিয়া অঞ্চলেও তারা দ্রুত এগোচ্ছে। পাশাপাশি কুপিয়ানস্ক এবং সিভারস্ক শহরের দিকেও তাদের চাপ বাড়ছে।
এই অগ্রগতি অবশ্য ধীরগতির এবং এতে প্রচুর প্রাণ ও অস্ত্রক্ষয় হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পুতিনের পুরো দোনেৎস্ক দখলের লক্ষ্য পূরণ হতে হয়তো আরও কয়েক বছর লাগবে। তবে রাশিয়ার গতি বাড়ছে। ইউক্রেনীয় গ্রুপ 'ডিপস্টেট'-এর তথ্যমতে, অক্টোবরে রাশিয়া যেখানে ২৬৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছিল, নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০৫ বর্গকিলোমিটারে।
বিশ্লেষক কাস্টহেলমি বলেন, "ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ সত্যিই খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হচ্ছে। আমি এখান থেকে বের হওয়ার কোনো পরিষ্কার পথ দেখছি না।"
আপাতত ইউক্রেনের হাতে ফ্রন্টলাইন টিকিয়ে রাখার মতো রসদ আছে, কিন্তু তারা চাপে নুইয়ে পড়ছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পুতিন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যেকোনো মূল্যে তিনি দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করবেন।
ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে প্রতিরোধ
গ্রীষ্মকালীন অভিযানে রাশিয়ার লাভ ছিল সীমিত। কিন্তু শরৎকাল থেকে পাশার দান উল্টে যায়। মাসের পর মাস গোলাবর্ষণ আর ড্রোন হামলার পর রুশ বাহিনী পোক্রভস্ক শহরের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
ইহোর নামের এক ইউক্রেনীয় ড্রোন পাইলট বলেন, সেপ্টেম্বর থেকে তাদের দিকের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে শুরু করে। তিনি বলেন, "ক্লান্তির কারণে লাইনগুলো ধসে পড়ছে।"
রুশ বাহিনী এখন ঝাঁকে ঝাঁকে 'কামিকাজে' বা আত্মঘাতী ড্রোন পাঠাচ্ছে। ইহোর বলেন, ইউক্রেনের কাছে এর পালটা জবাব নেই। তার মতে, বর্তমান শান্তি পরিকল্পনা আসলে 'ধোঁকাবাজি'। রাশিয়ানরা যতক্ষণ চাপ দিতে পারবে, ততক্ষণ তারা চাপ দিয়েই যাবে।
দোনেৎস্কের কোস্টিয়ানটিনিভকা এবং লিমান শহরেও রুশ বাহিনী হামলা চালাচ্ছে। ইউক্রেনীয় ক্যাপ্টেন ওলেহ ভোইতসেখোভস্কি বলেন, রুশরা সব দিক থেকে সব সময় আক্রমণ করছে। গত দুই মাসে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়েছে। ঘন কুয়াশার কারণে ইউক্রেনীয় ড্রোনগুলোর জন্য রুশ সেনাদের ছোট ছোট দলকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
পোক্রভস্কে এখন প্রতিদিন ঘন কুয়াশা নামে। ন্যাশনাল গার্ডের মাকসিম বাকুলিন বলেন, সেখানে পোড়া কয়লা আর বারুদের গন্ধ ভাসে। এক বছর আগেও শহরটি জীবন্ত ছিল। এখন রাস্তায় বেসামরিক আর সামরিক মানুষের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যা উদ্ধার করার কোনো উপায় নেই। রাশিয়া পোক্রভস্ককে অন্য দুটি বড় শহর দখলের সিঁড়ি হিসেবে দেখছে।
অনেক বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলছেন, এত ক্ষতি স্বীকার করে ইউক্রেন কেন পোক্রভস্কে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে? হয়তো শান্তি আলোচনার আগে কিয়েভ দেখাতে চাইছে যে তারা হারছে না। তবে ইউক্রেন যখন এক জায়গায় মনোযোগ দিচ্ছে, রুশ বাহিনী তখন জাপোরিঝিয়া অঞ্চলের হুলিয়াইপোল শহরের আশপাশে অনেকটা এগিয়ে গেছে।
শীতের আগমনে হয়তো যুদ্ধের গতি কিছুটা কমবে। ড্রোনের কারণে ফ্রন্টলাইন এখন আর শুধু রেখা নয়, বরং মাইলের পর মাইল বিস্তৃত এক 'কিল জোন' বা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।
রাশিয়ার সৈন্যসংখ্যা যেন অফুরান। প্রচুর প্রাণহানি হলেও তারা থামছে না। পোক্রভস্কের যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে এখন প্রতিবেশী শহর মিরনোহরাদ নিয়ে আতঙ্ক বাড়ছে।
সার্জেন্ট ওলেহ বলেন, সেখানে দিনে বা রাতে এক মুহূর্তের শান্তি নেই। রাশিয়ার নাইট ভিশন আর রসদ দেখে তিনি অবাক হন। তিনি বলেন, "আমাদের যদি তিনজন থাকে, ওদের আছে ৩০ জন। ওদের জনবল অবিশ্বাস্য।"
তবে তিনি এও যোগ করেন, "রুশরাও ভাবেনি আমরা এতদিন ধরে লড়াই চালিয়ে যাব।"
