ভুল শান্তিচুক্তি যেভাবে পরবর্তী যুদ্ধের দিকে পরিচালিত করতে পারে
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন একবার এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, 'আমার মতে, কখনো কোনো যুদ্ধ ভালো হয় না, আর কোনো শান্তি খারাপ হয় না।' আমেরিকান কূটনীতির জনক হলেও এই কথায় তিনি ভুল ছিলেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা কখনোই 'ভালো' নয়, কিন্তু শক্তি প্রয়োগ অনেক সময় ন্যায়সঙ্গত হতে পারে। আর বর্তমান সময়ে এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন 'স্বঘোষিত শান্তিস্থাপক' এখন দৃশ্যপটে আছেন। আসলে 'খারাপ শান্তি' বা বাজে চুক্তি বলেও কিছু আছে।
এ কারণেই গত ২২ নভেম্বর কানাডা, ইউরোপ ও জাপানের ১৫ জন নেতা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছেন। তারা ইউক্রেনের জন্য একটি 'ন্যায়সঙ্গত ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি' খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের কণ্ঠে ছিল জরুরি সতর্কবার্তা।
এই আহ্বানের পেছনে নৈতিক ও বাস্তব—দুই ধরনের ভয়ই কাজ করছে। আমেরিকার মিত্ররা ভয় পাচ্ছে, ট্রাম্প হয়তো এমন একপেশে শান্তির পথে হাঁটবেন যা শুধু রাশিয়ার পক্ষেই যাবে। ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ তা মেনে নেবে না। এতে দেশটির নড়বড়ে গণতন্ত্র ভেঙে পড়তে পারে। তারা আরও ভয় পাচ্ছেন যে, ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হয়তো এমন এক যুদ্ধবিরতি হবে যা পুতিনকে তার আগ্রাসনের জন্য পুরস্কৃত করবে। এতে ভবিষ্যতে ইউক্রেন বা ইউরোপে রাশিয়ার হামলা থামবে না।
বাতাসের দিকে ঘোরা আবহাওয়া নির্দেশক যন্ত্রের মতো ট্রাম্পের অবস্থানও ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। তবে তা এলোমেলো নয়। তিনি সামরিক শক্তি প্রদর্শন বা হম্বিতম্বি পছন্দ করেন। কিন্তু যুদ্ধ করতে নয়, বরং চুক্তির পরিবেশ তৈরি করতে তিনি এসব করেন। তিনি বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করতেই বেশি পছন্দ করেন। যেমন তিনি বলেছেন, ইউক্রেনের উচিত ছিল না আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ শুরু করা। বরং হামলাকারীর সঙ্গে তাদের আগেই 'চুক্তি করা' উচিত ছিল।
মানুষ কেন মূল্যবোধের জন্য যুদ্ধ করে, ট্রাম্প তা বুঝতে পারেন না। তার সাবেক সহকর্মীদের মতে, তিনি যুদ্ধের প্রবীণ সৈনিকদের 'বোকা' বা 'পরাজিত' বলে অবজ্ঞা করেন। তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভ্যান্স সম্প্রতি বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প ভাবেন ইউক্রেন ও রাশিয়া কেন মারামারি থামিয়ে একে অপরের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করছে না। তার মতে, বিশ্বে শান্তি থাকলে আমেরিকার শ্রমিকদের জন্যই ভালো।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, ট্রাম্পের শান্তি প্রক্রিয়ার মূলনীতি হলো—ফাঁকা বুলি বা ব্লাফিং। তিনি মনে করেন 'জোর যার মুল্লুক তার'। আর তার বিশ্বাস, যুদ্ধ ব্যবসার জন্য খারাপ। দুর্ভাগ্যবশত, ইতিহাস বলছে এই নীতিগুলো শান্তির বদলে ধ্বংসই ডেকে আনে। এমন শান্তির চুক্তি শেষ পর্যন্ত টেকে না।
বছরের পর বছর ধরে পণ্ডিতরা মনে করতেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির ওপর চাপানো ভার্সাই চুক্তি ছিল খুব কঠোর। এটিই অ্যাডলফ হিটলারের উত্থান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথ তৈরি করেছিল। ব্রিটিশ প্রতিনিধি জন মেনার্ড কেইনস তার বইয়ে এই ধারণা জোরালো করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী গবেষণা অন্য কথা বলে। কেইনস সে সময়ের অর্থনৈতিক বাস্তবতা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। ১৯১৮ সালে যুদ্ধের শেষে বেলজিয়াম, ফ্রান্স বা পোল্যান্ডের যে ক্ষতি হয়েছিল, তার তুলনায় জার্মানি বেশ সমৃদ্ধ ছিল।
ট্রাম্পের যুগের সঙ্গে এর একটা বড় মিল আছে। তখন বড় শক্তিগুলো শুধু ফাঁকা বুলি দিচ্ছিল। জার্মান নেতারা যখন মিথ্যা বলছিলেন যে তাদের সেনাবাহিনী হারেনি বরং রাজনীতিবিদরা পিঠে ছুরি মেরেছে, তখন বিশ্বনেতারা অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন। জার্মানি যখন ক্ষতিপূরণ দেওয়া বন্ধ করল এবং গোপনে অস্ত্র বানাতে শুরু করল, তখনো আমেরিকা ও ব্রিটেন কিছুই করেনি।
শান্তি চুক্তিতে আন্তরিকতা খুব জরুরি। মার্গারেট ম্যাকমিলান 'প্যারিস ১৯১৯' বইয়ের লেখক। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শান্তি চুক্তি কার্যকর করার রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তির কঠোরতা বা পরাজিত পক্ষ আলোচনায় ছিল কি না, তা বড় কথা নয়। ১৯৪৫ সালে জার্মানি ও জাপান অত্যন্ত কঠোর শর্ত মেনে নিয়েছিল। তখন তাদের কিছু বলার সুযোগ ছিল না। কিন্তু পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল 'স্নায়ুযুদ্ধ' বা কোল্ড ওয়ার। এর ফলে আমেরিকা এশিয়া ও ইউরোপে তার প্রভাব বজায় রেখেছিল। দেশ পুনর্গঠনে আমেরিকার সাহায্য মানুষকে বুঝিয়েছিল যে আমেরিকা একটি ভালো শক্তি।
ইতিহাস আমাদের আগ্রাসীদের তোষামোদ করার পরিণাম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। ১৯৩৮ সালে মিউনিখে ব্রিটেন ও ফ্রান্স হিটলারকে খুশি করতে চেকোস্লোভাকিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেইন বলেছিলেন 'আমাদের সময়ের শান্তি'। কিন্তু হিটলার শান্তি চাননি, তিনি যুদ্ধ চেয়েছিলেন।
ট্রাম্পের শান্তির তৃতীয় স্তম্ভ হলো—নীতির চেয়ে মুনাফা বড়। কিন্তু ইতিহাস এখানেও আশার কথা শোনায় না। এক দশক আগে জার্মান কূটনীতিক জোহানেস রেগেনব্রেখট 'মিনস্ক চুক্তি' নিয়ে কাজ করেছিলেন। ২০১৪-১৫ সালে রাশিয়ার আগ্রাসন থামাতে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তখন ফ্রান্স ও জার্মানি আলোচনার নেতৃত্ব দিয়েছিল। জার্মানি ইউক্রেনকে দুর্বল মনে করত এবং রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা বাড়াতে চেয়েছিল।
সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল জানতেন পুতিন ধোঁকাবাজ। তবুও তার সরকার 'স্থবির শান্তি' বা ফ্রোজেন পিস চেয়েছিল। তারা ভেবেছিল এতে ইউক্রেনের ক্ষতি কমবে এবং রাশিয়া ন্যাটো বা মলদোভার দিকে এগোবে না। জার্মানি রাশিয়ার সস্তা গ্যাস কেনা বাড়িয়েছিল। তারা ভেবেছিল একে অপরের ওপর নির্ভরতা রাশিয়াকে শান্ত রাখবে। জার্মান নেতারা ঝুঁকিটা বুঝেও ফলাফলের মুখোমুখি হতে চাননি।
আজ ইউরোপের বড় শক্তিগুলো শক্তিশালী জোটের ওপর ভরসা রাখছে। তারা নিষেধাজ্ঞা ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ওপর জোর দিচ্ছে। যদিও তারা ধীরে ধীরে অস্ত্র বাড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের ভয় অন্য জায়গায়। তারা ভাবছে আমেরিকা এমন এক পথে হাঁটছে, যা দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আনতে পারবে না।
